আমার পছন্দ

সোমবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০

 পাখিটা বন্দী আছে দেহের খাঁচায়

 সপ্তর্ষি বিশ্বাস

প্রথম প্রকাশঃ ডিসেম্বর ২০১১, 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি"  ও "ঈশাণের পুঞ্জমেঘ" ব্লগ 


রামায়ণে রামের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন রাবণ, মহাভারতে পান্ডবের কাছে কৌরব, কারবালা প্রান্তরের সেই যুদ্ধে, অবশেষে, হজরতের শুভানুধ্যায়ীদের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন এজিদ। ঠিক। কিন্তু এঁদের এই পরাজয়ের সঙ্গে কি কোনো ভাবেই তুলনা করা যায় হলিউড্‌ বা বলিউড্‌ ছবির নায়কের কাছে ভিলেনের পরাজয়ের? ঠাকুর সিংএর কাছে গব্বর সিংএর পরাজয়ের? হয়তো যায়না কেননা মহাকাব্যে নাত কেউ নায়ক, নাত ভিলেন। প্রতিটি চরিত্র তাঁর নিজ নিজ বিশ্বাসে অটল থেকে মেনে নেন আপন আপন পরিণতি। যথা ভীষ্ম, কর্ণ, ধৃতরাষ্ট্রসহ কৌরবেরা সকলে। সহজ কথায় একজন ভিলেন যেখানে তার ব্যক্তি আমির পার্থিব প্রলোভনের দ্বারাই লীপ্ত হয় সেই সব কাজে যা সে নিজেও জানে অন্যায় বলে সেখানেই মহাকাব্যের বা পরবর্তীতে ট্র্যাজিডির চরিত্রেরা তাই করে থাকেন যা তাঁদের বিশ্বাসে বিধৌত । যা অন্ততঃ চরিত্রটির কাছে মনে হয়না অন্যায় বলে। আর যেহেতু বিশ্বাসে বিধৌত তাই তাঁর কাছে সত্যও সেই ক্রিয়াই।   

                    এমনি এক বিশ্বাসে ভর করে বাইবেলের আব্রাহাম্‌ বা কোরানের ইব্রাহিমও, স্নেহ-মায়া-মমতার সমস্ত আকূতি পার হয়ে গিয়ে নিজের প্রিয়তম পুত্রকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন দেবতার আদেশে। সেই দৃশ্যে স্বর্গের করুণা নেমে এসেছিল মর্ত্যে । সন্তুষ্ট দেবতা আব্রাহাম্‌ বা ইব্রাহিমকে নিরত করেছিলেন বলীদান থেকে। কিন্তু দেবতাকে সন্তুষ্ট করবার পথে মানুষ হিসাবে আব্রাহান/ইব্রাহিম কি আমাদের চোখে হয়ে ওঠেনি যথেষ্ট অমানুষ? আদতে ক্ষমতার কাছে নুয়ে থাকলে ক্ষমতা করুণা দেখালে দেখাতেও পারে এমনই একটি ইঙ্গিত আমাকে দেয় আব্রাহান/ইব্রাহিম কাহিনী। তবে এই কাহিনীও, এই হেজেমনিও সম্ভবতঃ সামন্ত প্রথারই সত্য। কেননা ভাঙ্গতে বসা সামন্ত আমলে, এই বিংশ শতকে যে মানুষটি তার বিশ্বাসের মূল্যে তার কন্যাকে তুলে দিল দেবতার গ্রাসে তার সেই বলীদানের শেষ দৃশ্যে নেমে আসেনি দেবতার করুণা । শিশু আসমাকে কেড়ে নিয়েছিলেন দেবতা। ঠিক যেমন পুতুল নাচের ইতিকথায় কেড়ে নিয়েছিলেন সেই কবিরাজ দম্পতীকে। আস্‌মার পিতা কাজী সাহেব যদি নিজ কন্যাকে বাঁচাতে শরণ নেন এলোপ্যাথির তাহলে তাঁর হোমিওপ্যাথির বিশ্বাসের ভিত টলে যায় । ঠিক যেমন আয়ুর্বেদের দ্বারা নিজ মৃত্যুদিন ঘোষনা করে দিয়ে সেই দিনে মৃত্যু বরণ না করলে ব্যর্থ হয়ে যায় সেই কবিরাজের মর্মগত বিশ্বাস - যে বিশ্বাস তাঁর অস্তিত্বের কেন্দ্রবিন্দু, গ্রামবাসীর কাছে তাঁর ক্ষমতার জাদুকাঠি। তাই ঐ ঘোষিত দিনে গোপনে আফিং খেয়ে প্রকাশ্যে মৃত্যু বরণ করেন কবিরাজ দম্পতী। শশী ডাক্তার সবই টের পায় তবুও ঐ আত্মহত্যা দেখে নিশ্চুপে । দেখে, কোনো প্রতিকার করেনা কেননা সে জানে এখন যদি এঁদেরকে হাসপাতালে নিয়ে, এলোপ্যাথিক চিকিৎসায় যায় বাঁচিয়ে তোলাও তাতে এঁদের দেহটা বাঁচবে শুধু, আর কিছু নয়। এগিয়ে আসা বুর্জোয়া সময়ের ছায়া তার মর্মে পড়লেও সামন্ততান্ত্রিকতার শশীও পারেনি সামন্ততান্ত্রিক ভাবনার ছায়া থেকে পুরোপুরি বার হয়ে আসতে।


মাটির ময়নাতে শশীর সমান্তরাল ভূমিকায় দেখাযায় কাজী সাহেবের ছোটোভাই মিলন’কে। তবে এ যেহেতু দুই নিঃসন্তান বৃদ্ধ-বৃদ্ধার যুগলে আত্মহত্যা নয়, একটি শিশুর, যা’কে মিলন বড় করেছে, করছে কোলে পিঠে নিয়ে, তারই জীবন সংশয়, ফলে শশী ডাক্তার’হেন নির্বিকার হতে পারেনা মিলন। দ্বিতীয়তঃ সময় তখন আরো কিছুদূর এগিয়ে গিয়েছে। পরিচালক তারেক মাসুদের মর্মে নেই ‘শশী ডাক্তার’হেন সামন্তবাদের খোঁয়াড়ি। তাই তারেক মাসুদের প্রোটাগোনিস্ট, যেহেতু কাহিনীর সময়কাল সত্তরের দশক আর আবহ গ্রামীণ বাংলাদেশ (তৎকালীন পাকিস্তান) তাই মিলন স্বাভাবিক ভাবেই সরাসসি সংঘর্ষে তখনো যায়না সামন্তবাদ ও তজ্জনিত মূল্যবোধের বিপক্ষে। পক্ষান্তরে সে রোগীর অবস্থা বলে এলোপ্যাথি’র মিক্‌শ্‌চার’ নিয়ে আসে ডাক্তারের কাছ থেকে। তা গোপনে দিয়ে যায় ভাবী’কে। কিন্তু কাজী সাহেব, ঐ ইব্রাহিমের মতনই, যেন শেষ দৃশ্যে তেমনি কোনো অলৌকিক করুণা নেমে এসে কন্যাকে বাঁচিয়ে দেবে, এই আশায় সেই এলোপ্যাথি’র মিক্‌শ্‌চার’দেন ছুঁড়ে ফেলে । কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মেই অন্তিমে নামেনা সেই অলৌকিক করুণা। আস্‌মা’ হয় গ্রাস। দেবতার। বিনিময়ে কাজী সাহেব বন্ধ করেন তাঁর হোমিওপ্যাথির প্র্যাক্‌টিশ্‌। এ কোনো প্রতিবাদ নয়। এ এক অক্ষমের অভিমানমাত্র।

এই কাজী সাহেব কি তাহলে ভিলেন বা সত্যজিতের দেবী’র শ্বশুরমশাই’টির মতো বিকৃতকাম বা উন্মাদ? না। তা নয় আদপেই। এই কাজী সাহেবই বিশ শতকের ইব্রাহিম আর তাই কোরাণের ঐ গল্পটি ইব্রাহিম মাঝির কন্ঠে আগে থাকতেই আমাদেরকে শুনিয়ে রাখেন পরিচালক তারেক মাসুদ।

                              যন্ত্রণা’কি হয় না কাজী সাহেবের? হয়। কেননা তিনিও’ত মাটির ময়না’ই। তাঁকেও’ত বার বার অনুভব করতে হয়, হয়েছেঃ .... মাটির তৈরি ময়না বলেঃ তাইলে কেনে মনটা দিলে,না দিলে জোর যদি ডানায় .. পাখিটা বন্দী আছে দেহের খাঁচায়’ ( এই গানের কথায়, সুরে মিশে আছেন লালন থেকে হাসন রাজা তথাপি গানটি আমার কাছে একটি মৌলিক সৃষ্টির অবয়ব নিয়েই ধরা দেয় ..) তাঁর ধর্ম, যেহেতু তা আদপে পাকিদের মতোই, এক মোহ মাত্র, তাই , তা এক সময় তাঁকেই বন্দী করেছে। নিজের মর্মকোঠায় আলোবাতাসের প্রবেশপথ নিজেই দিয়েছেন বন্ধ করে। প্রতীক হিসাবে বারবারই আমরা দেখি নদীর দিকের জানালাটি বন্ধ করে দিচ্ছেন কাজী সাহেব আর সেই জানালাই খুলে দিচ্ছেন তাঁর স্ত্রী আয়েষা যিনি মাতৃত্বের, মমতার স্বাভাবিকতায় মুক্ত, মুক্ত সামন্ততন্ত্রের হেজিমনি থেকে, ধর্মমোহ থেকে। সেই জানালা খুলেই মিলন দিয়ে যাচ্ছে মেলায় কেনা কচুরী, ডক্তারের কাছ থেকে আনা ওষুধ

আয়েষা জানালা খুলে দেন, আয়েষা বলেনঃ আমারই কুনো যুদ্ধ নাই ...

  আয়েষা যখন বলেনঃ আমারই কুনো যুদ্ধ নাই’তখনই কিন্তু এক দিকে খান সেনা ঝাঁপিয়ে পরেছে পুব পাকিস্তানকে আত্ননিয়ন্ত্রণের অধিকার হেন বস্তু দাবী করবার জন্য সমুচিত শিক্ষা দিতে, পূর্ব পাকিস্তানের গড়িষ্ঠ সংখ্যক জনতা নেমে আসছেন প্রতিরোধের যুদ্ধে, আরেকদল ভাবছে পশ্চিম পাকিস্তানের জয় ইসলামের জয় ।  এরা প্রস্তুতি নিচ্ছে আরেক যুদ্ধের। গৃহযুদ্ধের।আয়েষা যখন বলেনঃ আমারই কুনো যুদ্ধ নাই’তখন স্বামী’র অনড়-অটল বিশ্বাসের মূল্যে চিকিৎসা বিভ্রমে বা বিন-চিকিৎসায় মারা গেছে তাঁর কন্যা আসমা । ছেলে আনু চলে গেছে, সেই স্বামীরই ইচ্ছায়, শহরে, মাদ্রাসায়। আয়েষার গুন্‌গুনিয়ে গান গাওয়া থেমে গেছে, থেমে গেছে সূঁচ-সূতোয় কাপড়ে ফুল তোলা । তবু আয়েষা বলছেন  আমারই কুনো যুদ্ধ নাই’ ...

আমি যেন স্তব্ধ হয়ে যাই। আমি টের পাই বাইরের, ভিতরের জানালাটিকে খুলে রাখার মূল্যে আয়েষা শুধু জেনেছেন বেঁচে থাকাটাই, থাকাটা’ই শেষ কথা । তাই শেষ দৃশ্যে খান সেনার হাত থেকে পুত্রটিকে রক্ষা করবার স্বাভাবিক তাড়নায় তিনি নেমে আসেন পথে। তখন তাঁর, তাঁদের আর হারাবার কিছু থাকেনা। পিছনে রয়েযায় খান সেনার তান্ডবে ছারখার হওয়া ভিটে, পুড়ে যাওয়া পুঁথির পাতা আগ্‌লে বসে থাকা কাজী সাহেব।

ছেলের হাত ধরে জীবনের সন্ধানে পথেনামেন আয়েষা কেননা তাঁর কোনো পুঁথিপড়া বিশ্বাসকে বহনের দায় নেই কাজী সাহেবের মতো। তাঁর ধর্ম মানবের ধর্ম। তাঁর ধর্ম মাতার ধর্ম। ... তবে যারা অত্যাচারী তাদের বিরুদ্ধে যাঁরা সংগ্রামে যান সেই সব মহাপ্রাণদের প্রতি আছে তাঁর মর্মে দরদ, মমতা।  তাই খানসেনা’র সঙ্গে যুদ্ধে মিলনের মৃত্যু সংবাদে কেঁদে ওঠেন তিনি । তথাপি শিশু পুত্রটিকে বাঁচানোর জীবন্ত বিশ্বাসের হাতে সঁপে দেন নিজেকে, ,ঐ সময় তাঁর পাশে থাকে সেই ইব্রাহিম মাঝি যে কখনো মিলন’কে বলেছিল যে প্রকৃত ধর্ম মানুষকে অন্ধ করেনা বরং আরো বেশী দেখতে শেখায়।


কিন্তু কাজী সাহেব দেখেননা, দেখেননা আনু’র মাদ্রাসা’র বড় হুজুর। তাই একজন সর্বদা নিজের কোঠার জানালাটি রাখেন বন্ধ করে আর আরেকজন অন্য’কে বন্ধ করে রাখার হুকুম জারি করেন ।  মনে আসছে তার্‌কোভস্কি’র নস্টালজিয়া’ যেখানে একজন যাজক তাঁর স্ত্রী ও পুত্রকে বারো বৎসর পাতাল ঘরে রেখে দিয়েছিলেন তাঁদেরকে পৃথিবী জোড়া পাপের কলুষ থেকে দূরে রাখতে।

মনে আসে মিলন আর তার বন্ধুদের সেই কথোপকথন যেখানে, ঠাট্টার মেজাজে হলেও, তারা বলে, যে, স-ব বাদ’ , মার্কসবাদ থেকে ফ্যাসীবাদ, জন্মেছে পশ্চিমেই আর আমরা সেইসব বাদ’ নিয়ে বাদাবাদি’ করে মরছি কিন্তু অবশেষে সেই মিলনই, সেই বন্ধুদের সঙ্গে অস্ত্র হাতে তুলে নেয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কেননা তখন আর কারোরই কিছু নেই হারাবার

                  ছবির আরেকটি বিশেষ মাত্রা আনু’র মাদ্রাসা’ জীবন, আনু আর রোকনের বন্ধুত্ব । রোকনের সেই নিজস্ব পৃথিবী যেখানে সে এনে জড়ো করে রেখেছে ভাঙ্গা সাইকেলের হ্যান্ডেল থেকে সিনেমার পোস্টার , যেখানে সে একা একা বসে ছবি আঁকে নিজের মনে । এর পাশাপাশি রয়েছে তৎকালীন সামাজিক বাস্তবতার দ্বান্বিক ( এবং মার্কবাদীও বটে ) উন্মোচন রয়েছে সেই প্রশ্ন ... ধর্ম না রাজনীতি কে নিয়ন্ত্রণ করে কাকে? ... পূর্ব পাকিস্তানের পতন কি প্রকৃতই ইসলামের পতন? গহনে কিন্তু রয়ে যায় সেই খোলা জানালা আর বন্ধ জানালার কাহিনী ।

 ছোটো হুজুর কেন ভালো? কেননা মাদ্রাসার এই শিশু গুলি তাঁকে মনে পড়ায় তাঁর কন্যাকে ... যেনবা কাবুলিওয়ালা’ আর বড় হুজুর, সেই কাজী সাহেবেরি মতন নিজেকে বন্ধ করে ফেলেন তাঁর অক্ষর কেন্দ্রীক ধ্যান ধারনায় আর সামন্ততান্ত্রিক অহংএ । ফলে দশ বছরের বালক রোকন বুঝতে পারে যে তার সহপাঠীটির ফার্সী হস্তলিপি ভালো নয় কেননা তার অভ্যাস বাঁ হাতে লেখার আর এখানে তাকে লিখতে হচ্ছে ডান হাতে । কিন্তু বড় হুজুর বোঝেননা ।তাঁর মনে হয় বাঁ হাতে ফার্সী লিখতে যাওয়াও যেন ইসলামের অবমাননা ...

        ছবিটির আরেকটি মাত্রা তার শেষ দৃশ্যে। কাজী সাহেব খান সেনা’কে ভেবেছিলেন শান্তির দূত। ইসলামের রক্ষাকর্তা। ফলে তিনি প্রকৃতই বিশ্বাস করতে পারেননি যে খান সেনা’র হাত থেকে যে তিনিও রক্ষা পাবেন না। কিন্তু বাস্তবে তা যখন ঘটলো না, তখন? ... মনে পড়ছে মিলান কুন্দেরা’র জোক’ উপন্যাসের একটি চরিত্র। সে এক কট্টর কমুনিষ্ট। তথাপি তৎকালীন কমিউনিষ্ট সরকার তাকে বন্দী করেছে এন্টি কমিউনিষ্ট’ সন্দেহে। জেলে এসে, জেল কর্তৃপক্ষ, যারা নিজেদের বলে কমিউনিষ্ট, তাদের ব্যাপার স্যাপার দেখে সে নিশ্চিত হয় যে এরা মূলতঃ নিও নাজি’ আর কমিউনিষ্ট’দের ভাবমুর্তি নষ্ট করার জন্যই এরা নিজেদেরকে বলে কমিউনিষ্ট । যুবকটি তখন গোপনে এক চিঠি লিখে তার আবাল্যের কমিউনিজ্‌ম্‌’ এর গুরুকে যিনি তখন কমিউনিষ্ট শাসন ব্যবস্থায় এক চাঁই ব্যক্তি।

সে চিঠি লিখে এবং আশা করে তিনি অবশ্যই এর কিছু একটা বিহিত করবেন।

     দিন সাতেক পরে, তার ডাক পরে জেলারের কোঠায়, সেখানে অন্য সমস্ত বন্দীদের সামনে জেলার তাকে দেখায় সেই চিঠিটি যা সে পাঠিয়েছিল তার কমিউনিজ্‌ম্‌’ এর গুরুকে ... তিনিই চিঠিটি পাঠিয়ে দিয়েছেন , ঐ জেলারের কাছেই । বিশ্বাসের এই অপমৃত্যু সইতে পারেনা সে ।  যে ছেলে অন্য সমস্ত বন্দীদের জীবনের আশা জোগাতো সে’ই ছেলেই ঐ রাত্রে আত্মহত্যা করে কন্ঠনালীতে ক্ষুর চালিয়ে।

     বিশ্বাস ভঙ্গের এই এক পরণতি। কাজী সাহেব কি যাবেন সেই দিকে? আবার আমরা’ত এ’ও জানি, যে, যে রাতে সকল দুয়ারই ঝড়ে ভেঙ্গে যায়, সে রাতেই তিনিও এসে দাঁড়ান আমাদের ঐ ঘর ভরা শূন্যতাকে ভরিয়ে তুলতে। তবে কি কাজী সাহেব, আজ যখন তাঁর ঘর-দোর-ভিতর-বাহির সবই ভেঙ্গে গেলো ঝড়ের আঘাতে, তখন, দেখা পাবেন সেই বিরাটের যা’কে তিনি জানালা বন্ধ করে দূরে সড়িয়ে রেখেছিলেন এতো দিন? ...

   এই প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়েই অন্ধকার পর্দায় ভেসে ওঠে নামলিপি। আর আমি টের পাই মহাকাব্যে কেউ ভিলেন হয়না, হয়না ট্র্যাজিডিতেও ।  না এখানেও খান সেনা’ও নয় ভিলেন এরাও লড়ছে ইসলাম বাঁচাও’ হেন উন্মাদনার ঝোঁকে । কিন্তু এই বিংশ শতকে ভিলেন ভিন্ন সম্পূর্ণ হতে পারেনা কোনো কাহিনী’ই আর তা’ই মহাকাব্য কেন সঠিক ট্র্যাজিডিও হয়না আর রচিত । তাই মাটির ময়না’ও বলে এক ভিলেনের কথা ... তবে ইয়াহিয়া খান নয়, সে বলে ক্ষমতা’ই আসলে ভিলেন, অন্ধ ক্ষমতা, লোভ,যার কেন্দ্রে মাকড়সার মতন ওঁৎ পেতে বসে থাকে সাম্রাজ্যবাদ, নতুন চেহারায়। সেই ছদ্মবেশী লোভের হাত এড়াতে পারেননি মার্লো’র ফস্টাস্‌, গ্যাটের ফাউস্ট ... অতি উৎপাদন আর বিশ্ব বাণিজ্যের হাতে জন্ম যে মেফিস্টোফিলিসের তাকে  ফস্টাস্‌ বা ফাউস্ট’ও যদি এড়াতে না পারে তাহলে কি করে পারবে গ্রামের সরল, বোকা মানুষেরা, কাজী সাহেব সে’ওত এক জন মানুষই ... যেহেতু মানুষ সেই হেতু সে’ও কি নয় এক মাটীর ময়নাই? ...

 

আদিলেখনঃ ৫ ডিসেম্বর ২০১১

সম্পাদনাঃ ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০

রবিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০

‘ভাসিপুর’ একটি গ্রামের নাম

 ভাসিপুরএকটি গ্রামের নাম

সপ্তর্ষি বিশ্বাস



প্রথম প্রকাশঃ ‘ঋত্বিজ’ উৎসব সংখ্যা, রজৎ জয়ন্তী বর্ষ ( ২০১৭)

 

 


 ১।

লক্ষণীয় হয়,এই,যে, সমগ্র মহাভারতে মহামতি বিদুরের ব্যক্তিগত জীবন, যে জীবন কুরু-পান্ডবের কাহিনী বহির্ভূত, যে জীবনে বিদুর নিজ পত্নী-পুত্র সন্নিবেশিত তার বিষয়ে মহাভারত অসম্ভব নিশ্চুপ। এই বক্তব্যের নিশ্চয়তা নির্ণয়ে, যাঁরা মহাভারতের পৃষ্ঠায় পুনরাবগহনে পরাঙ্মুখ, তাঁদের জন্য ইরাবতী কার্ভের ‘Yuganta: the end of an epoch’ গ্রন্থের ‘Father and Son’  নামক অধ্যায় অথবা নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ীর কথা অমৃত সমান এর ২য় খন্ডের কয়েকটি অধ্যায় পাঠই যথেষ্ট। মহাভারত ব্যাখ্যাতাদের অনেকের ধারনা,হয়,এই মতোও,যে, কুন্তী ও বিদুরের অন্যতর সংশ্রব ছিল এবং সেই সংশ্রবহেতু, অন্য চারজন না হোক, অন্ততঃ যুধিষ্ঠির বিদুরেরি ঔরসজাত। সম্ভবতঃ বিবাহোত্তর কালে কুন্তী প্রথমবার গর্ভবতী হওয়াতে, যেহেতু কানা মনে মনে জানা, লোকলজ্জার ভয় বা জনকৌতুহল এড়াতেই চলে গিয়েছিলেন বনবাসে। ততোদূর যাঁরা মেনে নিতে চাননা তাঁরা এইটুকু নিশ্চয়ই মানবেন যে কৌরব-পান্ডবের আখ্যানের প্রথম থেকে অন্তিমাবধি বিদুরই ছিলেন কুন্তীর অন্যতম পরামর্শদাতা। সুহৃদ। বান্ধব। ইন্টিগ্রেল ক্যাল্‌কুলাসের হস্তীশূঁড়হেন চিহ্নটির মতন বিদুর বেষ্টন করে আছেন মহাভারতকে।

                           একই ভাবে নাসির আহমেদও ঘিরে থাকে শাহিদ খানের পরিবারটিকে সেই শাহিদ খানের রেলগাড়ি লুঠ করার আমল থেকে শাহিদের পৌত্র ফয়জল খানের ধ্বংসের পরেও। যেভাবে ধাবমান মৃত্যুর হাত থেকে সে রক্ষা করেছিল শাহিদ-পুত্র নাবালক সরদার খানকে তেমনি শাহিদের প্রপৌত্রটিও, অন্তিমে, রক্ষা পায় নাসির আহমেদেরই নিমিত্ত।

এই মহাভারতে ঐ শেষ দৃশ্যটিই শান্তিপর্ব।




এই দৃশ্যটিই অন্তিমপর্ব যেখানে বোম্বের কোনো রেল ইস্টিশানের কিনারে খান বংশের একমাত্র যষ্টিটিকে লোরি শোনাতে শোনাতে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে নাসির। বাজছে গান এক বগ্‌ল্‌ মে চান্দ্‌ হোগা, এক বগল মে রোটিয়া/ এক বগল মে নিন্দ্‌ হোগি, এক বগল মে লোরিয়া... যে গান বেজেছিল শাহিদ খানের ভাসিপুর ত্যাগ করে ধানবাদের পথে যাত্রার মুহুর্তে। হ্যাঁ, এই মুহুর্তে শাহিদও উদ্বাস্তু। প্রাণের ভয়ে পলাতক। ১৫ ই অগাস্টে ঘোষিত স্বাধীনতার মূল্যে আমার পিতামহ, প্রপিতামহদের মতই। উদ্বাস্তু উর্ধ আসামের বংগাল খেদার অত্যাচারে পলাতক বাংলাভাষী জনতার মতই। উদ্বাস্তু পান্ডব ভ্রাতাদেরও মত। ছবিটি নিয়ে লিখতে বসে ফিরে ছবিটি দেখতে গিয়ে টেরপাই শাহিদের মতই উদ্বাস্তু যেন এই মানবজাতিও।  শাহিদের মতো সেও কি চায়না নিদ্রা, বিশ্রাম, স্বপ্ন ... ইংরেজি সাবটাইটেলে গানটির কথা লিখিত আছে এই ভাবেঃ

I dream of a bejeweled moon, and some warm bread.

I dream of gentle sleep, and a lullaby in my head.

My dear moon...

এই শান্তির নিদ্রার স্বপ্নেই কি উপত্যকা থেকে উপত্যকার দিকে যাত্রা করেনি মানুষ, সভ্যতার ঊষালগ্নেরো আগে? এই  শান্তির নিদ্রার স্বপ্নেই কি আজো সে ছুটে যায়না গ্রাম থেকে,মফস্বল থেকে শহর, নগর, বন্দরের দিকে? তবু সে পায় কি সেই নিদ্রার সন্ধান নাকি

চাঁদ, যেন জীবনানন্দের, ইয়েট্‌সের প্রতীকী চাঁদ, দেখে, চেয়ে চেয়ে দেখে এই যাত্রা

ফিরে আসি নাসির আর বিদুরের প্রসংগে। পুনরায়।  বিদুর এবং নাসিরের সাদৃশ্য আরোও এই, যে, বিদুর দাসীগর্ভজাত আর নাসির আহমেদ শাহিদ খানের তুতো ভাই হওয়া সত্ত্বেও সে আদতে ছিল শাহিদের হ্যান্ডেল। নাসিরের নিজের ভাষায় নোওকর্‌। তথাপি বিদুরের যুধিষ্টির প্রীতির মতনই অপত্য স্নেহে সে দায় নিয়েছিল সরদার খানের। কিনারে দাঁড়িয়েছিল সর্বদা।

অন্তিমে, আপাততঃ, এই, যে বিদুর-কুন্তীর যৌন সংসর্গ থাকা না থাকা নিয়ে তর্ক করা গেলেও নাসির এবং সর্দার খানের পত্নী নাগ্‌মা খাতুনের মধ্যে, একবার যৌন সংসর্গ ঘটতে চলেছিল, প্রকৃত, কিন্তু অন্তিমে তা ঘটতে পারেনা সেই রাত্রে। ঘটতে পারেনা আর কোনো দিনই। নাসির আহমেদের নিজের কথায় মেরে আউর নাগ্‌মা কে বিচ্‌ যো হোতে হোতে রহগেয়া থা য়ো ফির্‌ কভি নেহি হুই... আর সেই না হওয়া”র নিরিখেই নাসির আহমেদ পৌঁছে গেছে আরো কিছুদূর-বিদুরের দিকে

এতাবৎ এসে, আমি নিশ্চিত, রেগুলার হিন্দি বই” দেখা, আমাহেন, বখে যাওয়া চার অক্ষরের বোকা পাব্লিকেরা ঠিকই টের পেয়ে গেছে, যে, কে এই নাসির, সরদার, কুরেসি এট্সেট্রা।

“দ্বিজোত্তম, সত্য কূলজাত”দের জ্ঞাতার্থে বলি ছবির নাম গেংস্ অফ ভাসিপুর”। পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপ। ছবিটি পরিচালকের এক খন্ডে মুক্তির ইচ্ছা থাকলেও অবশেষে পাঁচ ঘন্টার ছবি একবারে দেখানোর রিস্ক কোনো ডিসট্রিবিউটারই না নেওয়ায় দুই খন্ডে ছবিটি মুক্তি পায় ২০১১-১২ সালে।

এই মহাভারতের যেখানে আরম্ভ সেখানে চল্লিশের দশকের পরাধীন ভারতবর্ষ। সেখানে ধানবাদ শহর। সেখানে শাহিদ খান পেট পালনের কারণে সুলতানা ডাকু’ সেজে লুঠ করছে সরকারী মালগাড়ি যে গাড়ি লুঠের অধিকার’ ধানবাদের কুরেশী’দের মতে রয়েছে কেবল তাদেরি।

এই মহাভারতের নেপথ্যে যে কাহিনী, যার জন্ম সেই কৃষ্ণদ্বীপে, সেখানে ১৯৯৩ ইংরেজি। একটি ১৯ বৎসর বয়সের ছেলে উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে দিল্লীর কোনো এক চলচ্চিত্র উৎসবে ডেসিকা’র বাইসাইকেল থীফ্‌’ ছবিটি দেখে। সে তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে চলচ্চিত্র পরিচালক হওয়ার । পাড়ি জমাচ্ছে বোম্বাই শহরে

২।


এতোদূর ভূমিকা করে এইবার আমার যাত্রা হবে আমার প্রতিপাদ্যের দিকে
যে প্রতিপাদ্য নির্মীত হয়েছে আমার মর্মে,অজান্তেই।  ছবিদুটি ( গেংস্‌ অফ্‌ ওয়াসিপুর পার্ট ১, পার্ট ২) ২০১২ সাল থেকে অদ্যাবধি প্রায় শতাধিকবার দেখবার আবডালে আমার মর্মনির্মীত প্রতিপাদ্যটি হয়, এই, যে, ইচ্ছায় বা আকস্মিকতায় এই ছবিতেও ছায়া ফেলেছে মহাভারত। কাহিনীতে। কথনে। অতএব চিত্রভাষাতেও তা হয়েছে প্রতিফলিত আর সেই ছায়াপাত অঘোষিত এবং অবলীল। - এই ছায়াটিকে ধারণ করার আবডালে এই চলচ্চিত্রটিও হয়ে উঠেছে একটি এপিক।

... এই চলচ্চিত্রটিও হয়ে উঠেছে একটি এপিক” এই আমার মূল প্রতিপাদ্য। এইবার ইউক্লিডিয় জ্যামিতির নিয়মে, হে পাঠক প্রয়াস নেই এই প্রতিপাদ্যের সত্যাসত্য নির্ণয়ে।

৩।

অনুরাগ কাশ্যপের প্রায় সমস্ত ছবিতেই আমি খুঁজে পাই ইটালিয়ান নিও রিয়েলিয়েলিজম’এর  সঙ্কেত।  রসোলিনী বা ডেসিকা’র মতন অনুরাগের ছবিতেও আবহ পালন করে এক বিশাল ভূমিকা। রসোলিনির ছবিতে যেমন যুদ্ধ বিধ্বস্ত রাজপথ নির্মাণ করে আত্মহত্যার আবহ অথবা ডেসিকার উম্‌বের্তো ডি’তে যুদ্ধবিক্ষত প্রাসাদোপম বহুতল  চালচিত্র হয় প্রোটাগোনিস্ট ডি’র নিঃস্বতার এবং যার নিরিখে দৃশ্যটি পায় বিস্তীর্নতর মাত্রা তেমনি গ্যাংস্‌ অফ্‌ ভাসিপুর”এ চল্লিশ থেকে নব্বই’র দশক অব্দি সময়ের পট পরিবর্তনের ইঙ্গিত হিসাবে বড় রাস্তায়, বস্তি অঞ্চলের গলীর দেওয়ালে সাঁটা সিনেমা পোস্টারের মৃদু ব্যবহার, বিশেষ সময়ে জনপ্রিয় বিশেষ টিভি সিরিয়েল ও সিনেমার সূক্ষ প্রয়োগ দৃশ্যগুলিকে এবং অন্তিম প্রস্তাবে গোটা ছবিকেই দেয় বিস্তীর্নতর মাত্রা।

‘ইটালিয়ান’এবং নিও রিয়েলিয়েলিজম’শব্দদুটির প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হয় এই হেতু, যে, তাঁর নির্মাতা চরিতের দিকে তাকালে আপাতভাবে মনেহতেই পারে যে অনুরাগের ছবিতে ছায়া ফেলেছে ফরাসী নিউ ওয়েভ”ও। আদতে তা হয়ত সত্য নয় কেননা  ফরাসী নিউ ওয়েভ” যেভাবে মার্ক্সবাদী বিশ্ববীক্ষাকে প্রয়োগ করেছে অনুরাগ এতাবৎ সেই পথে যাননি। বিশেষতঃ এইছবিতে তো নয়ই। ইতিহাসের গতিপথে উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থার ভূমিকাকে স্বীকার করে নিয়েও অনুরাগ আসলে হেঁটে গিয়েছেন মহাকাব্যেরই দিকে যা ফরাসী নিউ ওয়েভ” এর বিপরীত না হলেও অভিপ্রেত ছিলনা আবার যা ইটালিয়ান’ নিও রিয়েলিয়েলিজম’এ এসে পড়েছে অবলীলায়।

অনুরাগের ছবিতে ১৯৪৭ সালে প্রাপ্ত ভারতের স্বাধীনতা” ও তৎপরবর্তী অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন বাহিত ব্যক্তি মানসিকতার, মনোস্তত্ত্বের পরিবর্তন এবং এই ব্যক্তি মানসিকতার পরিবর্তন হেতু গোষ্ঠীর পরিবর্তনের দ্বান্দিকতা ফিরে ফিরে আসে। -তবে এতাবৎ এ’র গভীরতম  প্রকাশ- কাহিনীমাধ্যমে, চিত্রভাষায় গেংস্‌ অফ্‌ ওয়াসিপুরেই’।

“অপেশাদার” বা বলা ভালো পর্দাসফল” অভিনেতা অভিনেত্রীর প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনুরাগ এতাবৎ গ্ল্যামার এক্‌টর’ প্রায় ব্যবহারই করেননা ছবিতে। বরং নাওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকির মতন সাংঘাতিক বড় মাপের অভিনেতা যিনি এতাবৎ ছিলেন দর্শকচক্ষুর প্রায় আড়ালেই  তাঁকে অনুরাগ হাজির করেন দর্শক সকাশে। প্রোটাগোনিস্টের ভূমিকায়।  অতঃপর বলিউডচাল কিংবা অন্য যেকোনো হেতুর অহেতুকতায় নাওয়াজুদ্দিন যদি  কোনোদিন শাহরুখ খান হয়ে ওঠেন তবে সেই  দায় অনুরাগের নয় অবশ্যই।

৪।



“গ্যাঙ্গস অফ বাসিপুরে”র আরম্ভই ভিষ্মকে অমান্য করে।  ভাসিপুরের  বৃদ্ধ  প্রধানের উপদেশকে লঙ্ঘন করে ।

কুরেশীরা শাহিদ খান কে উৎখাত করলো। কুরেশীদের দাবী তারা ভূমিপুত্র। শাহিদ কুরেশী” বংশোদ্ভূত নয়। তবে শাহিদ খানও মুসলমান। উভয়েপক্ষই সুন্নি”। শাহিদের দাবী অস্তিত্বের দাবী। সেই দাবীতেই তার সুলতানা ডাকু”র ছদ্মপরিচয়ে রেল ডাকাতি। কুরেশীরা শাহিদের এই দাবী” দিলো খারিজ করে। অথচ  সেই বৃদ্ধ প্রধানের  প্রতি ভরসা ছিল শাহিদের। সুতরাং যখন তাঁর কাছে দরবার বসলো শাহিদ হাজির হলো মৌন এই দাবী নিয়ে, যে, যাপনের প্রয়োজনের কাছে সে অসহায়। অতএব ...

বৃদ্ধ বলেওছিলেন মারামারি, কামড়াকামড়িতে না গিয়ে , যেহেতু জীবনধারণের অধিকার এ সসাগরা ধরণীতে প্রত্যেকেরই, অতএব শাহিদ ডাকাতি বন্ধ করুক। ডাকাতি চালাক কুরেশীরাই। তবে প্রতি ডাকাতির অন্তে কুরেশীরা কিছু কিছু আনাজ” দিয়ে আসবে শাহিদকে । এ যেন শাহিদকে পাঁচটি গ্রাম নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে বলা। শাহিদও সম্মত হয়েছিল তাতে । কিন্তু বিনাযুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী”  নব প্রজন্মের কুরেশীরা তাদের বৃদ্ধ গপ্রধানকে অমান্য করে এই প্রস্তাব ঘোষনা করলে শাহিদ বাধ্য হল এই বসতি ছেড়ে উঠে যেতে ।

এই বৃদ্ধ  কেন আমার মনে নিয়ে আসেন ভীষ্মকে? মনের গতিক জানেন না মন নিজেও। আর আমরা, অভাজনেরা, বাইরে থেকে আমরা তার গতির নিরিখের অনুমানই করতে পারি শুধু। সিনেমা এই কারণেই ভিসুএল মিডিয়াম”। বৃদ্ধের শুভ্র কেশে, শুভ্র শিরবেষ্টনীতে, বলীরেখায়, মুখময় বয়সের ঊর্ণনাভ জালে, চশমায়, দৃষ্টির তীক্ষ্ণতায় আদতে মনে পড়েছিল Sotigui Kouyaté ( বাংলায় কি বানান, কি উচ্চারণ হবে তা নির্ণয় আমার পক্ষে অসম্ভব ) কে যিনি পিড়াত ব্রুকের মহাভারতে ছিলেন ভীষ্মের ভূমিকায়। পশ্চিম আফ্রিকার এই অভিনেতার উপস্থিতির আবহে যেন সতত থাকে এক অদৃশ্য চালচিত্র যা নীরবে ঘোষনা করে   “Tribal Wisdom” এর সত্যকে।  - ওই সূত্র ধরেই মনে আসেন ভীষ্ম, আলোচ্য এই চলচ্চিত্রেও। এই ভীষ্মও বলেন রক্তপাতের অসারতার কথা।

কিন্তু কৌরবেরাও যেমন ভীষ্মের Wisdom কে ফুৎকারে প্রত্যাখান করেছিল এখানে এই   কুরেশীদের ক্রোধের মর্মেও ক্রিয়াশীল সেই অহংকারই  যা তার পিতা রাজা বলে,  ছিল দুর্যোধনের । হয়ত ন্যায্যতই  ছিল এই অহং, এই অধিকার বোধ কৌরবদের। কুরেশীদের। তথাপি রক্তক্ষয়ের অসারতার কথা বিস্মৃত হয়েছিল কৌরব, কুরেশী দুই পক্ষই। দুই ভূগোলের। দুই যুগে।

পক্ষান্তরে পাণ্ডবেরা- যারা মূলতঃ নয় কুরুপক্ষের কারোরই ঔরসজাত-তাদের প্রতিশোধস্পৃহা ।  তবে পাণ্ডবদের তুলনায় শাহিদ খান’কে স্বীকার করে নিতে হয়  নিরীহতর কেননা সে সত্যই চেষ্টা নিয়েছিল, ভিনগ্রামে গিয়ে তথাকথিত সৎ পথে জীবন যাপনের।

কিন্তু সেখানেও বাদ সাধল তার নিয়তি । সে খুন হল। খুনের প্রতিশোধ নিতে প্রস্তুত হলো তার পুত্র সরদার খান। ক্রমে কুরেশী আর না-কুরেশীদের লড়াই মোড় নিল এক ত্রিমুখী যুদ্ধে।  কাহিনীর আরেক প্রস্থানবিন্দু সূচিত হল এই পর্বে। যেন জীবনানন্দ, যেন এক বগল মে চান্দ হোগি”র চাঁদ বলে উঠলঃ

যেখানেই যাও চলে, হয় নাকো জীবনের কোনো রূপান্তর;

এক ক্ষুধা এক স্বপ্ন এক ব্যথা বিচ্ছেদের কাহিনী ধূসর

ম্লান চলে দেখা দেবে যেখানেই যাও বাঁধো গিয়ে আকাঙ্ক্ষার ঘর!

—বলিল অশ্বত্থ সেই ন’ড়ে ন’ড়ে অন্ধকারে মাথার উপর ।

(বলিল অশ্বত্থ সেই, জীবনানন্দ দাশ)

৫।

‘মাফিয়া’, কয়লা মাফিয়া’ যে আগেও ছিল তা আমাদের বলেছেন অনুরাগ। দেখিয়েছেনও। ১৯৪৭ এর পরে শুধু যা ঘটলো তা এই মাফিয়াদের প্রভুদের নামগুলি পরিবর্তিত হল মাত্র। মাফিয়াদের কর্ম প্রণালী ও নিত্যকর্মে পরিবর্তন কিছুই ঘটল না। পরিবর্তন বলতে তারা ছাড়পত্র পেলো আরো বেশী অত্যাচারের। নৃসংশতার। যে কয়লা মাফিয়া’র কারণে একদা শাহিদ খান অক্ষম হয়েছিল নিজ পত্নীর মৃত্যুশয্যার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে, যে কয়লা মাফিয়া’র একজনকে প্রকাশ্যে সে হত্যা করেছিল সে’ই শাহিদ খানই এবার স্বাধীন” ভারতবর্ষের কয়লা মাফিয়া”। - শাহিদের এই স্বাভাবিক মেটামরফোসিস” শ্রেণী চেতনার উন্মেষ ও বিকাশধারার বিশ্লেষণের প্রক্রিয়ায় যোগ করে দেয়না’কি আরেকটি মাত্রা?

“মেটামরফোসিস” উত্তর শাহিদ খান’কে আমরা প্রথমে দেখি আগুনের আবহে যেখানে সে তার একদা কমরেড” খনি শ্রমিকদের ঝুপড়ি পোড়ানোর তদারকি করছে মালিকের হয়ে। পরের দৃশ্যেই জল। ঝড়জল। বৃষ্টি। তুমুল।

আগুন ও জলের এই প্রয়োগ আমাকে মনে করায় মহাকাব্যে আগুন ও জলের প্রয়োগ। বুদ্ধদেন বসু তাঁর মহাভারতের কথা”র দশম পরিচ্ছেদ আগুন-জলের গল্প”তে বিষয়টি যেভাবে বিশদ করেছেন তার অন্তর্যাস, হয়, এই, যে, আগুন ও জল এই দুই বিপরীত শক্তির মিলন ও দ্বন্দ্বের মর্মে মহাকাব্য রচয়িতাদের নানান গহন ইংগিত সমাচ্ছন্ন।

আগুন ও জলের ভিতর দিয়ে শাহিদ খানকে এনে তারপর তাকে তার মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে অনুরাগও কি রেখেছেন কোনো প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত? জানিনা। তবে অনুভব হয় ওই দুই বিপরীত আবহে, পর পর দুটি শটে শাহিদ’কে না দেখলে  তার মেটামরফোসিস”, অন্ততঃ আমার মর্মে, পর্দায় হয়ে উঠতনা ততোদূর গ্রহণযোগ্য।

অনুরাগের চিত্রভাষা এভাবেই,ক্রমশঃ, কাহিনীর মহাকাব্যিক বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে, হয়ে উঠেছে মহাকাব্যিক।

৬।

যে কাহিনীর আরম্ভ কুরেশী আর পাঠানদের সংঘাতে, যার বিস্তার রামাধীর সিং নামক নব্য খনি মালিকের সঙ্গে শাহিদের দ্বন্দ্বে সেই কাহিনীর পরিণতি ও পরিণাম অবশেষে কুরেশী-খান-রামাধীর’এর এক ত্রিমুখী লড়াইএ।

রামায়ণ ও মহাভারত উভয়ই মূলতঃ ত্রিমুখী যুদ্ধের কাহিনী ।

রামায়নে রাবনের প্রতি তার প্রতিশোধস্পৃহা নিবৃত্ত করতে রাম সঙ্গে নিল সুগ্রিবকে। অথবা বলাযায়, যে, বালীকে হত্যা করে সিংহাসনে বসবার বাসনায় সুগ্রীবই আঁতাত করল রামের সঙ্গে । অন্তিমে নিরপরাধ রাবণ, যে মূলতঃ অকারণে অপমানিতা তার ভগিনীর অপমানের শোধ তুলতেই বন্দী করেছিল সীতাকে, হলো ধ্বংসপ্রাপ্ত। রাবণ ধ্বংস হল ঠিক। কিন্তু রামের জীবনেও আর পূর্বের শান্তি ফিরে এলনা । কিন্তু সুগ্রীব তার রাজ্য চালাতে লাগল সুখেই।

মহাভারতেও যাদব বংশকে শক্তিশালী করবার কূট ধান্দা”তেই কৃষ্ণের পাণ্ডব শিবিরে যোগদান । মূলতঃ । জরাসন্ধ, কংস ইত্যাদির ক্ষমতায় শঙ্কিত, চিন্তান্বিত  কৃষ্ণ, বলরাম বা নেতাশ্রেণীর অন্যান্য যাদবগণের মনস্তত্ত্ব খোদ মহাভারত ছাড়াও সংখ্যাতীত মহাভারত ব্যাখ্যাতার মসীতে বিবৃত। অতএব কোনো বিশেষ রেফারেন্স দর্শানো এক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয়। বরং দেখা যাক কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের নিয়তির দিকে।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কৌরবরা হল ধ্বংসপ্রাপ্ত । পাণ্ডবরা রাজত্ব পেলেও তার আড়ালে তাদের সন্তান বিয়োগের, আত্মীয় বিয়োগের শোক ছিল প্রবহমান । কিন্তু যাদব বংশের কোনো core member  কিন্তু নিহত হয়নি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে । যদিও পরবর্তীতে যদুবংশও ধ্বংস হয়েছিল- তথাপি তাৎক্ষণিক ভাবে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ যাদবদেরকেই এনে দিয়েছিল সবচেয়ে বেশি লাভ। প্রচুর আখের।

অনুরাগের ছবিতেও কুরেশীদের সঙ্গে সরদার খানের বা তার পিতা শাহিদ খানের দ্বন্দকে কাজে লাগিয়ে রামবীর সিং চেষ্টা নিয়েছিল তার নিজস্ব যাদব বংশ” কে শক্তিশালী করে তুলতে । এই ত্রিমুখী যুদ্ধের অন্তর্গত সামাজিক ও  রাজনৈতিক বাস্তবতার ইঙ্গিত অবশ্যই অনুধাবনীয়। কিন্তু এই মুহুর্তে তা আমার নিজস্ব প্রতিপাদ্য, যাকে যাচাই করে নিতেই এই অক্ষরপ্রচেষ্টা, তা ব্যাহত হবে যদি লিপ্ত হই সামাজিক ও  রাজনৈতিক বিশ্লেষণে। পরিবর্তে দেখা যাক এই ত্রিমুখী লড়াই কাহিনীকে উর্বর করেছে কি কি অনবদ্য সম্ভাবনায়, চরিত্রে।

        যে কাহিনীর আরম্ভ কুরেশী আর পাঠানদের সংঘাতে, কুরেশী পরিবারের সঙ্গে খান পরিবারের বৈবাহিক সম্বন্ধের মধ্য দিয়ে অবশ্যই ইতি হতে পারত ওই ক্রনিক” গৃহযুদ্ধের । কিন্তু বাদ সাধল সুলতান কুরেশী” ।

সরদার-পুত্র দানিশের সঙ্গে নিজ ভগিনীর বিবাহ যখন সে আপ্রাণ চেষ্টাতেও আটকাতে পারলোনা তখন সে নিজ আত্মীয়বর্গকে ত্যাগ করে চলে গেল । রামবীর সিং তাকে, ভবিষ্যতে, কুরেশী ও খান পরিবারের মধ্যে এই বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার পরও, আর মদত” করবে কি না এহেসান কুরেশীর কাছে অন্ততঃ তখন তা ছিল অনিশ্চিত । বরং কুরেশী-খান” জোট  যে তাকে যে কোনো মুহুর্তে নিঃশেষ করে দিতে পারে এই ছিল প্রকৃত বাস্তবতা।  টের পাওয়া সত্বেও সে রাজ্যের আশ্বাস” বা  নিরাপত্তার প্রয়োজনে যোগ দিলনা নিরাপদ শিবিরে । - এই অর্থে সেও জিহাদী” । যে পক্ষের পরাজয় , সে পক্ষ ত্যাজিতে মোরে করনা আহ্বান’ ...

জিহাদী কর্ণের মতোই তারো মৃত্যু অসহায় ভাবে । ব্রাহ্মনের ছদ্মবেশে সূর্য্যদেব এসে ভিক্ষা করে নিয়ে গিয়েছিল কর্ণের কবচ কুণ্ডল আর এখানে, এই গল্পে, ফয়জল খানের পালিত গুপ্তচর, সুলতান যখন মসজিদে, নামাজনিরত তখনি,মশজিদের পাঁচিলের কিনার ঘেঁষে দাঁড় করানো তার গাড়ীর ড্যাশ্‌বোর্ডে  রাখা পিস্তল থেকে সবগুলি গুলি  খুলে নিয়ে চলে গেল । অতএব আক্রান্ত হওয়ার পর সুলতান কুরেশী আত্মরক্ষাহেতু বৈধ যুদ্ধেরও সুযোগ পেলোনা ।

 


 ৭।

এই ত্রিমুখী যুদ্ধের করাল ছায়াপাত ঘটেছে অন্তঃপুরেও। রামাধীর সিং এর অন্তঃপুরের খবর তেমন কিছু জানান না অনুরাগ। মূলতঃ কুরেশী আর খান পরিবারের নারীচরিত্রদের নানান মাত্রায় উন্মোচিত করে এই কাহিনী।

নারী চরিত্রদের মধ্যে দুর্গা ব্যাতীত অপর প্রত্যেক প্রধান নারী চরিত্রই নিজ পতির প্রকৃত সহধর্মিনী।

 দুর্গা সেই মেয়ে যাকে শয্যাসঙ্গিনী করেছিল সরদার খান। তখন সে বিবাহিত। সে পালিয়েছে জেল থেকে আর সেই পালানোর প্রক্রিয়ায় তার স্ত্রী নাগমা ও তাদের বড়ছেলে, তখন যে সদ্য কিশোর, নিয়েছে মুখ্য ভূমিকা। কিন্তু দুর্গার দেহ সৌষ্ঠবের আকর্ষণ, তার পলাতক ও নারীহীন জীবনে, এড়িয়ে যেতে পারেনা সরদার খান।

সরদার খান দুর্গাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেওয়ার পরেও, দুর্গার গর্ভে নিজ সন্তানোৎপাদনের পরেও সরদারের প্রথমা পত্নী নগমা সংকটে সম্পদে” পতির পার্শ্বে থাকে সরদার খানের পিতৃহত্যার প্রতিশোধ” ব্রতের সহায় হয়ে যে ব্রতে” সে ছিল বিবাহের প্রথম দিনবধি- সরদার খানের সহায়।

একইভাবে  নগমার পুত্রবধু এহসান কুরেশীর ভগ্নি শমা পারভীন সেও কুরেশী খান গৃহযুদ্ধের পুনর্সূচনায় , পতিরই অনুগামিনী । পরিণামে তাকে প্রাণ দিতে হয় নিজ ভ্রাতা সুলতান কুরেশীর গুলিতে।

দুর্গা ভিন্ন অপর নারী চরিত্রগুলির সপত্নী ছিলনা আর দুর্গার সপত্নী নগমা,হয়তোবা মুসলমান সমাজে বহুবিবাহের বৈধতার দরুনই,অভিমানসহ হলেও,অন্তিমে,মনে মনে, দুর্গাকে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু দুর্গা কদাপি পারেনি সপত্নীর অস্তিত্বকে পরিপাক করতে। পরিপাক করতে পারেনি সরদার খানের দ্বারা তার গর্ভসঞ্চার। এই পরিপাক করতে না পারার মূল্যে এই চরিত্রটিতে এসেছে অন্য মাত্রা যা অপর নারী চরিত্রগুলিতে অনুপস্থিত।

দুর্গা হয়তবা গোপনে রামবীরের অঙ্কশায়িনীও হয়েছিল সরদার খানের অনুপস্থিতিতে । তার সরদার খানের প্রতি যে ক্রোধ তা কেবলই সপত্নী ঈর্ষা নয় । সে গর্ভবতী হতে চায়নি । সে মূলতঃ উপভোগ করতে চেয়েছিল নিজ যৌবনকে। যৌনতাকে। সে স্পষ্ট বলেওছিল, যে, সে নাগমা’র মতো বেলুন” হতে চায়না বছর বছর।  কিন্তু তাকেও বেলুন” বানিয়ে দিয়ে বাদ সাধল সরদার খান । তদুপরি সরদার খান হলনা তার একা’র সম্পত্তি ।

নগমা খাতুন যেন এখানে গান্ধারী । সে এক গামিনী । পক্ষান্তরে সে কুন্তীও বটে। কুন্তীরই মতন সে পুত্রকে ভর্ৎসনা করে, উত্তেজিত করে যুদ্ধে।

 আবার দুর্গার সঙ্গে কুন্তী চরিত্রের প্রাথমিক সাদৃশ্য এই, যে,  সে’ও কুন্তীরই মতন বহু অঙ্কশায়িনী- ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় । দ্বিতীয়ত সে’ও যুদ্ধই চায় কুন্তীর মতন। সে তার ক্রোধের নিস্পত্তি ঘটাতে নিজ পুত্রের নাম পর্য্যন্ত দেয় ডেফিনিট” কেননা সে চায় ঐ পুত্রের জীবনের লক্ষ্য হোক সরদার খানের পতন । যেহেতু সরদার খান ততদিনে দুর্গারই চক্রান্তে মৃত , অতএব ডেফিনিটকে সে ব্যবহার করে সরদারের বংশ ধ্বংস করতে ঠিক যেমন কুন্তী যুদ্ধে অনিচ্ছুক যুধিষ্ঠির কে যুদ্ধ প্ররোচনা দিয়ে যায় অন্তিমাবধি ।

৮।

ভারতীয় চলচ্চিতের ইতিহাসে গ্যাঙ্গস অফ বাসিপুর” এমনই এক মাইল ফলক যা অনুরাগ নিজেও আর পার হয়ে যেতে পারবেন কি’না কেজানে। পাঠক, এই ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, যে, এই রচনাটি যখন লিখিত হচ্ছে তখন গ্যাঙ্গস অফ বাসিপুর”-উত্তর বোম্বে টকিজ”, আগ্‌লি”, বোম্বে ভেলভেট” থেকে রমণ রাঘব” পর্যন্ত ছবিগুলি অনুরাগদ্বারা নির্মীত ও দর্শক সমক্ষে মুক্ত হয়েগেছে। এই ছবির প্রতিটি চরিত্র দাবী রাখে বহুমাত্রিক বিশ্লেষণের। চিন্তার। এই ছবি বারবারই মনে আনে মহাভারত’কে। পাঠক, সরদার-পুত্র পার্পেন্ডিকুলার”এর নিধনদৃশ্য কি মনে এনে দেয়না অভিমন্যু বধের কাহিনীকে? এই মনে এনে দেওয়ার আবহ কেবল কাহিনীচালিত নয়। ক্যামেরা চালিত। পার্পেন্ডিকুলার বন্ধুর সঙ্গে মোটর সাইকেলে বাড়ি ফিরছে। তিন মিনিটের একটি শট মূলতঃ হলদেটে আলোর আবহে। কাট্‌। এবার আবহ নীল। আরো দু মিনিট। গপ্পে মশগুল দুই বন্ধু। তারপরই মুহুর্তে চক্রব্যূহ। গাড়ির হেডলাইটের আলোতে নীলাভ আবহ বিখন্ড। টানা শট্‌ নেই এখানে। কাটা কাটা। কাট্‌ কাট্‌ ... সুলতান কুপিয়ে কাটছে পার্পেন্ডিকুলারকে। ক্যামেরা উঠছে নামছে কাটারীর সঙ্গে সঙ্গে ...

এমনি আরো অনেক দৃশ্যের, চরিত্রের অবতারণা করা যায় অবশ্যই। কিন্তু আপাততঃ তার প্রয়োজন নেই যে প্রতিপাদ্যটির যাথার্থ্য সন্ধান ছিল আমার এই অক্ষর প্রচেষ্টার মর্মে, যে প্রতিপাদ্যটি হয়, এই, যে, ইচ্ছায় বা আকস্মিকতায় এই ছবিতেও ছায়া ফেলেছে মহাভারত। কাহিনীতে। কথনে। অতএব চিত্রভাষাতেও তা হয়েছে প্রতিফলিত আর সেই ছায়াপাত অঘোষিত এবং অবলীল। - এই ছায়াটিকে ধারণ করার আবডালে এই চলচ্চিত্রটিও হয়ে উঠেছে একটি এপিক তা সম্ভবতঃ প্রমাণিত।

তবে যে দুটি দৃশ্যভিন্ন ছবিটি কোনোভাবেই এপিক হতে পারত না তার প্রথমটি রাত্রির নিঝুম ছাতে ফয়জলের আত্মোপলব্ধি আর তার কথন নিজ পত্নী মহসিনার কাছে। অন্যটির কথা বলার আগে বলে নিই যে ছবিটির প্রতিটি সংগীত, আবহ সংগীতও তেমনি এপিক। দুর্গাপুত্র ডেফিনিট এসেছে ফয়জলের দেহরক্ষী হয়ে। অন্তর্গত উদ্দেশ্য ফয়জলের নিধন। ডেফিনিট গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ফয়জলকে। আবহে যে গান হচ্ছে তার ইংরেজি অনুবাদ (সাবটাইটেলে) এইঃ

I'm the Devil's son,

raised in the laps of witches.

I'm the keeper of graves,

dogs are my supper.

That's funny 'cos humans like you

are just a snack for me.

I'm the Serpent King, a vulture...

I'm disease and filth.

So what? I'm a cannibal...

I don't even spare cattle feed.

You don't scare me...

I sold the deed I made with the Devil.

Fuck your deed!

I just sold the fucking Devil himself!

পাঠক, এই গান, গানের কথা, সুর যদি মনেপড়ায় ম্যাকব্যাথের ডাইনীসংগীত তাহলে এই মনেপড়া কি অন্যায্য?

  অন্তমে বলি সেই দ্বিতীয় দৃশ্যটি যা ছবিটির এপিক চরিত্রকে সম্পূর্ণ করেছে

এই দৃশ্যে আবার সেই গান যা দিয়ে আরম্ভ হয়েছিল শাহিদ খানের যাত্রাঃ

I dream of a bejeweled moon, and some warm bread.

I dream of gentle sleep, and a lullaby in my head.

My dear moon...

এই বার এই গানকে আবহে রেখে নিহত ফয়জলের শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে এই মহাভারতের যে বিদুর, সেই নাসির খান। এই ভূগোল ভাসিপুর থেকে অনেক দূরে। বোম্বাইতে। ইস্টিশানের কাছাকাছি। চলেযাচ্ছে রেলগাড়ি। ফয়জল পত্নী মহসিনা এসেছে স্নান সেরে।

নাসির খানকে দেখে মহসিনা যে মাথায় ঘোমটা দিচ্ছে তার হেতু কি? সে’কি শ্বশুরস্থানীয় নাসিরের প্রতি তার স্বাভাবিক সম্মান প্রদর্শন। নাকি ...

... যেটাই হোক, অন্তিমে এই দৃশ্য এনেদেয় সেই ইঙ্গিত যার মর্মে শোনাযায় জীবনানন্দের স্বরঃ

“এই পৃথিবীর রণ,রক্ত,সফলতা সত্য

তবু শেষ সত্য নয় ...

ছবি ফুরায়।

কিন্তু কাহিনী ফুরায় কি? ফুরায় কি মহাকাব্য? কোনোদিন?

 

 

 

৩রা সেপ্টেম্বর ৭ই নভেম্বর  ২০১৬

বেঙ্গালোর

 

জাফর পানাহি ও তাঁর ‘বৃত্ত’

                                   জাফর পানাহি তাঁরবৃত্ত

সপ্তর্ষি বিশ্বাস

প্রথম প্রকাশঃ 'মিরুজিন, সংখ্যা , ১৪ই আষাঢ়,  ১৪১৯

 


১।

কামুরআউটসাইডারএর প্রোটাগোনিষ্ট যখন হঠাৎই গুলি করে খুন করে ফেল্লো একজন মানুষকে এবং কোনো চেষ্টাই করলো না আত্মরক্ষার বা আত্মপক্ষ সমর্থনের , চরিত্রটির শ্রষ্টা কামু যখন এই হত্যার কোনো হেতুই উল্লেখ করতে অস্বীকার করলেন গোটা উপন্যাস-শরীরে, সেই ১৯৪২ সালে, ইউরোপীয় আধুনিকতা যে বিন্দুতে গিয়ে দাঁড়ালো তার মুখোমুখি, ১৯৬০ সালে মুক্তি পাওয়া গোদারেরব্রেথ্লেস্ছবির গাড়ি চোর প্রোটাগোনিষ্টশেষ দৃশ্যে যে ইচ্ছে করলেই পালাতে পারতো পুলিশের হাত থেকে, অথচ পালালো না, কারন হিসেবে জানান দিলো সে পালাতে পালাতে এখন ক্লান্ত এবং ক্লান্তির মূল্যে সে পুলিশের গুলি খেয়ে লুটিয়ে পরলো রাজপথে

তাকে দাঁড় করিয়ে দিলে ইউরোপীয় আধুনিকতার একটি গতিপথ হয়তো লক্ষ্য করা যেতে পারে।

কামু আউটসাইডারের মর্মের যে শূন্যতার বোধ, যেস্ট্রেঞ্জনেস্তা যতোদূর অনুধাবনীয় তার চেয়ে ঢের অনুধাবনীয় গোদারের প্রোটাগোনিষ্টের ক্লান্তি কেননা সেআউট্সাইডারনয়, মানুষ হিসাবে তার কামনা-বাসনা, তার জিজীবিষা সবই বহুদূর অনুধাবনীয়। সে কামু Meursault এর মতোপেটি বুর্জোয়ানয়। বরং সে, Michel, সেই শ্রেণীরই খুব কাছাকাছি যাদেরশৃঙ্খল ছাড়া হারাবার আর কিছু নেই ... কাছাকাছি, তবু সে তা নয় কেননা সে ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন না ঘটাতে না চেয়ে বরং ব্যবস্থাতেই আশ্রয় চায়, চায় প্রেম ... কিন্তু এই ব্যবস্থা তাকে সে সব কিছু না দিয়ে বরং বেড়ায় তাড়া করে ... ফলতঃ এক সময়আত্মঘাতী ক্লান্তি হয়ে ওঠে তার নিয়তি ... পক্ষান্তরে কামু প্রোটাগোনিষ্টের যে ক্লান্তি তা যদিওআত্মঘাতীকিন্তু সমান্তরালে সে ঘাতকও বটে।

       প্রায় ভুলে যাওয়া দুটি চরিত্রের কথা মনে এলো জাফর পানাহিক্রিমসন্গোল্ড্ (Talaye sorkh, ২০০৩) ছবিটি ফিরে দেখতে বসে কেননা এখানেও, একটি হত্যা এবং আত্মহত্যা প্রথম দৃশ্য থেকেই তাড়া করে ফেরে দর্শককে ... কিন্তু এখানে হত্যাকারীহুসেননা কামু আউট সাইডার, না সে গোদারের মিচেল ... তার যে সংকট তা দিনগত প্রাণ ধারনের সংকট। সে বেঁচে থাকতে চায়। সে আনন্দ পায় মোটর সাইকেলে চেপে ঘুড়ে বেড়াতে। সে বাঁচিয়ে রাখতে চায় অন্যকে। পেটের দায়ে বয়স বাড়িয়ে সৈন্যদলে ঢুকে পড়া বালকের ক্ষুধার্ত মুখ তাকে বাধ্য করে বিলিয়ে দিতে সেই পিজা যা তাকে দেওয়া হয়েছিল খদ্দেড়কে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। মোটর বাইকে ঘুরে ঘুরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পিজা পৌঁছে দিয়ে আসার চাকরীটি ছাড়াও সে, তার হবু শ্যালকের সঙ্গে মিলে করে পকেট-মারা ব্যবসা। আশ্চর্য এই, যে, পকেট মারার ব্যবসাতেও ছায়া ফেলে তার জীবন তৃষ্ণা ... এই যার চরিত্র সে কেন খুন করে ফেলে, প্রায় অকারনেই একজন মানুষকে? কেন খুন করার পরেও, তার বন্ধু যখন জীবনপণ আশ্বাস দেয়আমি আছি তোমার সঙ্গে...’ সে কেন পরবর্তী গুলিটি চালিয়ে দেয় তার নিজের খুলিতে? এই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজবার আমার যে ব্যক্তিগত প্রয়াস, পাঠক, তা আমি আপনার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিচ্ছি এই রচনায় এতদ্ভিন্ন এই ইন্টারনেট্‌-সময় তথ্য নিয়ে আলোচনা করার কোনো অর্থ হয়না কেননা উৎসাহি পাঠক চাইলেই পানাহি আর তাঁর সিনেমা বিষয়ে অসংখ্য তথ্য সংগ্রহ করে নিতে পারেন ইন্টারনেটে। অতএব এই ইন্টারনেট সময়ে আলাপ আলোচনায়, তথ্য নয়, অনুভবের ভাগাভাগিই বোধকরি একমাত্র অর্থবহ বিনিময় ...

    ২০০৩ সালে তোলা এই ছবিটির আগে, ২০০০ সালে জাফর পানাহি নির্মাণ করে ফেলেছেন ‘The Circle’, যা আমার মতে শুধু নয়, বিশ্ব সিনেমার প্রায় সমস্ত দর্শক-সমালোচকদের মতেই তাঁর প্রথম পরিণত ছবি। সেই ছবি ঝড় তুলেছে সিনেমা-ইতিহাসে, পানাহি পেয়েছেন ভেনিসের গোল্ডেন-লায়ন ... সে সমস্ত আজ সর্বজনজ্ঞাত চবিটি বিষয়ে পানাহি যে কথাটি আমাকে ভাবিত করে তা হলো এই, যে,  ‘The Circle’ পানাহি মূলতঃ দেখতে দেখাতে চেয়েছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিয়তিকেঃ Panahi sees the new work as an artistically more mature piece. It is his examination, as he indicated to us, of the fate of his child characters, so to speak, when they grow up. The difficulties of childhood now assume quite different proportions. ( সূত্র WSWS) বিশদ আলোচনায় যাওয়ার আগে এখানে শুধু টুকু বলে নিই, যে, ‘The Circle’ অন্তিমে, তার বহুমাত্রিক গমনের শেষে, বলে একটি কথাস্বর্গ নেই। স্বপ্নের স্বর্গ নেই। নিজ নিজ স্বপ্নকে অবয়ব দিতে চেয়ে যে যে পথেই ছুটে যাক অবশেষে তাদের ক্ষমতা নেই সেই বৃত্তকে ভেঙ্গে বার হয়ে আসার যে বৃত্তের প্রতীক শেষ দৃশ্যের জেলখানা ... যে জেলখানাকে পানাহি হাজির করেছেন প্রথম দৃশ্যের হাসপাতালের সমান্তরালে .... এখানে এসে মনেপড়ে ঋত্বিকেরসুবর্ণরেখা সেই দৃশ্য যখন ঈশ্বর চক্রবর্তী নিজেকে পরাজিত ভেবে চলেছে আত্মহত্যা করতে আর তখনি এসে হাজির হচ্ছে হরপ্রসাদ , বলছে যে পথেই যাও না কেন অবশেষে পরাজয়ই ধ্রুব পাঠক জ্ঞাত আছেন যে, একটি চাকরি পেয়ে নিজের ছোট্ট বোনটিকে একটিঘরদেওয়ার বাসনা নিয়ে উদ্বাস্তু কলোনীর থেকে চলে এসেছিল ঈশ্বর চক্রবর্তী আর হরপ্রসাদ, পক্ষান্তরে উদ্বাস্তু কলোনী আঁকড়ে পরেছিল সমস্ত উদ্বাস্তুদের স্বপ্নকে অবয়ব দেওয়ার আকাঙ্খায় ... বৃত্ত। এতোদূর একটি বৃত্ত নির্মাণ করেছিলেন ঋত্বিকও। কিন্তু তারপর, ছবিতেই, বৃত্তকে ভেঙ্গে ঋত্বিক এগিয়ে নিয়ে চললেন ঈশ্বর চক্রবর্তীকেই ... এবার তার হাত ধরে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, মৃত বোন সীতার নাবালক ছেলে ... তারও চোখে স্বপ্ন, তার মার মতোই, ঘরের, নীড়ের

             পানাহির  ‘The Circle’  বলেনা বৃত্ত ভাঙ্গার কথা। বলে বৃত্ত ভাঙ্গার স্বপ্নগুলির ভেঙ্গে যাওয়ার কাহন। বলাও এক অভূতপূর্ব ভঙ্গীতে। যেন একটি রীলে রেস। একটি চরিত্রকে ধরে কাহিনী এগিয়ে চলে কিছুদূর। জানা যায় চরিত্রটির আশা, সাধ, স্বপ্ন এবং তার অব্যবহিত পরেই সে মিলিয়ে যায় ... কোথায়? আপাতঃ ভাবে জানা যায়না। পরিবর্তে চরিত্রটি, যেতে যেতে, তার কাহিনী-মশাল দিয়ে যায় অপর চরিত্রকে ... এবং অবশেষে সেই সমস্ত হারিয়ে যাওয়া চরিত্র একত্রিত হয় জেলখানার অন্ধকার কুঠুরীতে ... ইঙ্গিত বলতে রয়েযায় শিশুটি যাকে আলোকিত জীবন দেওয়ার স্বপ্নে তার মা তাকে ফেলে পালিয়ে আসে ... তারপর অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে, যেন কুন্তী, যেন Moses’এর মাতা Yoshebel ... সেই শিশু কন্যাটিকে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ, তাকে এবার ভরন-পোষন করবেসরকারসে বড়ো হবে ... ভালো হবে ... মাটি চেয়েছিল কন্যাটিকে নিয়ে যাক কোনো সূত অধীরথ কিন্তু পরবর্তে সরকারী অনাথ আশ্রমের হানাদারিকে সে মেনে নেয় ... আশায় আপনাকে সংহত করতে চায় মাটি ... কিন্তু মাটির মনেও যেমন, আমাদের মনেও তেমনি রয়েযায় প্রশ্ন, যে সরকার, যেব্যবস্থা অত্যাচারে মা এবং আরো অসংখ্য মা, ভগিনী আজ জীবন্মৃত তার হাতে কি করে সঠিক ভাবে বেড়ে উঠবে শিশু?...

  



 

২।

স্বর্গ নেই। স্বপ্নের স্বর্গ নেই। আছে শুধু এক বৃত্ত। এক Vicious circle মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ, মনেপড়েঃ সেখানে মানুষগুলো সব ইতিহাসের ছেঁড়া পাতার মতো / ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে  /মশালের আলোয় ছায়ায় তাদের মুখে /বিভীষিকার উল্কি পরানো ...

পানাহিসার্কলএ তাই। শুধু মানুষের পরবর্তে এক বিশেষ লিঙ্গের মানুষ। তারা মহিলা। মহিলাদের মধ্যেও তাদের শ্রেণী আলাদা।পুরুষের প্রতিরক্ষাহীন মহিলা প্রতিটি পুরুষ এদের অশালীন ইঙ্গিত করে। রাষ্ট্র ব্যবস্থা চায় পরিচয় পত্র। পথচলতি তথাকথিত দম্পতী এদের দেখে সন্দিগ্ধ চোখে। আবার দলেরি কেউ কেউ নিজের পূর্ব পরিচয় গোপন করে আশ্রয় চায়পুরুষএর কাছে। সেজে ওঠেদম্পতী পক্ষান্তরে কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধেদম্পতীশব্দের সন্ধি ভেঙ্গেপত্নীটিকে ভিড়ে যেতে হয়, অকস্মাৎ ইতিহাসের ছেঁড়া পাতারমিছিলে ... তাদের ঠাঁই হয় জেলখানায়, লোক চক্ষুর আড়ালে ... এখানে এসে মনে পড়ে Michel Foucault, তাঁর Madness and Civilization: Leprosy disappeared, the leper vanished, or almost, from memory; these structures (কুষ্ট রোগীদের নিমিত্ত নির্মীত জেলখানা স্বরূপ হাসপাতাল গুলি )remained. Often, in these same places, the formulas of exclusion would be repeated, strangely similar two or three centuries later. Poor vaga-bonds, criminals, and "deranged minds" would take the part played by the leper, ... আজ যখন পথে পথে ঘুরে বেড়ানো উন্মাদের সংখ্যা কিছুটা কমে গেছে তখন শূন্য স্থান পূর্ণ করতেই যেন সব মহিলাদের ধরে আনা যারা প্রকাশ্যে সিগারেট খাওয়া, অর্থাভাবে গয়না বন্ধক দিতে যাওয়া বা (স্বামী দ্বারা পরিত্যক্তা হয়ে) ‘পুরুষহীনহয়ে চলাফেরা করাহেন  মারাত্মক অপরাধে অপরাধী ... প্রকৃত অর্থে, যেমন বলেছেন ফুকো, একই গ্রন্থে, যে, যেহেতু তথাকথিত reason তার সীমবদ্ধতা হেতু ব্যাখ্যা করতে অক্ষম হয় উন্মাদের unreason কে তাই না বোঝাটিকে সে চোখের আড়াল করে দিতে চায়। এখানে reason হয় তার power game এর মূল ঘুঁটি, ঠিক একই ভাবে মহিলাদের (আসলে সমাজের সমস্ত মহিলাদেরই) সাধ-স্বপ্নকে অনুধাবন করতে ব্যর্থব্যবস্থাতাকে সড়িয়ে দেয় চোখের আড়ালে। জেল খানায়। পরবর্তে কায়েম রাখে তার আধিপত্য ...

   যদিইরানবা বিশেষ কোনো সময় সমাজকে বাদও দিই তাহলেও পানাহির সার্কল এই কথা বলে, যে, যখনি এক দল মানুষের সাধ-স্বপ্নকে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয় তথাকথিতসমাজবাব্যবস্থাতখন  তাকে  সে সড়িয়ে দিতে চায়  চোখের আড়ালে ... সেইএকদলকখনো ইরানের মহিলা, কখনো সত্তরের দশককেমুক্তির দশককরে তোলার স্বপ্নে বিভোর যুবক-যুবতী, কখনো তিয়ানম্যান স্কোয়ারে জমায়েত হওয়া ছাত্র-ছাত্রী, কখনো জালিয়ানোয়ালা বাগের অহিংস জনতা ...

   সার্কলছবিটি দেখতে দেখতে মিশেল ফুকোকে মনে পড়ে আবারো । তাঁর History of Sexuality তে আমরা দেখেছি শুধু Sex নয়, sex বিষয়ে আলোচনাও কিকরে হয়ে ওঠে ক্ষমতার প্রতীক।সার্কল আমরা দেখি সিগারেট খাওয়ার মতো তুচ্ছ বাস্তবতা কি ভাবে নেয় স্থান। পক্ষান্তরেক্রিম্সন্‌-গোল্ড দেখি হুসেনের হবু শ্যালক হুসেনকে বলে যে সে তার বাবাকে সম্মান করে বলে বাবার সামনে সে সিগারেট খায়না, খায়না হুসেনের সামনেও। অথচ হুসেনকে সে সিগারেট জ্বালিয়ে দেয়। মোটর বাইকে হুসেনের পেছনে বসে সে সিগারেট খায়। এখানে এসেসম্মান জানানোপ্রক্রিয়াটির অন্তর্গত ক্ষমতা-সমীকরনের অন্য একটি সংজ্ঞা নির্মাণ করতে চান নাকি জাফর পানাহি? – হয়তো চান, নাহলে পানাহি ছাড়া অন্যদের ছবিতে কেন এভাবে উঠে আসেনাস্বর্গ নেই, স্বপ্নের স্বর্গ নেইএর বদ্ধ বাস্তবতা? এই মুহুর্তে মনে পড়ছে অন্য যে সব প্রিয় ইরানি ছবি গুলির কথা সে গুলিতে মানুষকে সিঁড়ির মতো ব্যবহার করে পরিচালক বলেছেন বহু বহু গভীরতর নীলাকাশের কথা । এলোমেলো ভাবে আমার মনে আসছে কিছু নামঃ

Children of Heaven (1997) মজিদ মজিদি

The Cyclist (1987) মহসীন ম্যাক্বালেফ্

আব্বাস কির্মাস্তমি  Koker Trilogy (1987–94), Taste of Cherry (1997), and The Wind Will Carry Us (1999).Where Is the Friend's Home?, And Life Goes On (1992) (অন্য নামঃ  Life and Nothing More), Through the Olive Trees (1994),Pedar/ Father  (1996),  The Song of Sparrows (2008) মজিদ মিজিদি ...

কিন্তু আকাশের বদ্ধতার, খন্ডতার কথা শুনেছি কি এই ছবি গুলিতে?  মনেহয় শুনিনি, মনেহয় জাফর পানাহি বদ্ধতাকে পর্দায় হাজির করার অপরাধেই হারালেন স্বাধীনতা। তাঁকে গিলে খেতে চাইলো বৃত্ত। কিন্তু সক্ষম হলো কি? এতাবৎ? যদি হতো তাহলে কি জন্ম হতো This Is Not a Film নামের ছবির? Genre এর? ...

 ৩।

The Circle এরইতিহাসের ছেঁড়া পাতার মতোচরিত্র গুলি বৃত্ত ভাঙতে চায়না। এরা বৃত্তের পরিধিতে ঘুরে ঘুরে খোঁজ করে ফাটলের, ছিদ্রের যা দিয়ে নিজে লে যাওয়া যায়, গলিয়ে দেওয়া যায় সন্ততিকে। পক্ষান্তরে Crimson Gold’ এর হুসেন ভাবেই, বৃত্তীয় দেওয়ালের শরীরে ফাটলের খোঁজ করতে করতে এক সময় যেন ভেঙ্গে ফেলতে চায় দেওয়ালকে, বৃত্তকে। এই হঠাৎ ভেঙ্গে ফেলতে চাওয়ার মর্মেও থাকে একটি প্রায় অবাস্তব অভিজ্ঞতা। অর্ডার করা পিজা পৌঁছে দিতে সে হাজির হয় এক প্রাসাদোপম ফ্ল্যাটে যাতে রয়েছে সদ্য আমেরিকা ফেরৎ এক যুবক। আমেরিকায় তার মা বাপ থাকে। সে ছিল কিছু কাল কিন্তু ফিরে এসেছে হোম্সিক্নেসের তাড়নায়। যুবক পিজা অর্ডার করেছিল তার বান্ধবীদের জন্য যাদেরকে সে এখন ‘whore’ শব্দেই চিহ্নিত করছে। সেই ‘whore’  দুজন পিজার অর্ডার দিতে বলেছিল ঠিক, কিন্তু পিজা এসে পৌঁছানোর আগেই তারা চলে যায়। এবার, শূন্য প্রাসাদে তিন তিনটে পিজা নিয়ে কি করবে সে? তাই সে পিজা গুলি হুসেনিকেই বলে নিয়ে গিয়ে খেয়ে নিতে। কিন্তু হুসেনও একা। তিনিটে পিজা দিয়ে কি করবে সে? এবার সেই যুবক বলে যে তবে বেশ ভালোই হলো, আমিও একা, তুমিও একা ...এসো দুজনে মিলে এখানে পিজা খাই...  ইত্যবসরে আমি আমারকথাগুলি বলি তোমাকে ... (এখানে যুবকের একাকীত্ব মনে পড়ায় Kar Wai Wong বা Wong Kar Wai’ ‘My Blueberry Nights’ এর সেই কোটিপতির কন্যাটিকে যে কেবল মাত্র কথাটুকু বলবার প্রয়োজনে মিথ্যা অছিলায় আটকে রেখেছিল ভাগ্যান্বেষী এলিজাবেথকে ...) ... রাত্রে, প্রাসাদোপম গৃহটি, ক্রমে, হুসেনের মর্মে হয়ে ওঠে এক objective correlative ... বিত্তের আনাচে কানাচে ঘুরতে ঘুরতে যেন সে টের পায় যুবকের প্রয়োজন নেই বিত্তে , কেননা যুবক জানেনা বিত্তের প্রকৃত ব্যবহার । পক্ষান্তরে তার প্রয়োজন আছে বিত্তে । হয়তো অনুভবই তার মর্মে ফিরিয়ে আনে সেই জুয়েলারী-শপ্আর তার ম্যানেজারকে যে ম্যানেজার বার বারই তাকে জানিয়ে দিয়েছে যে দোকানে ঢুকবারযোগ্যসে নয় সে প্রথমে ভাড়া করা পোশাকে বড়লোক সেজে ঢুকেছিল, ঠিক, কিন্তু এইবার সে আর ভাবে ঢুকতে নারাজ ... এইবার সে চায় নিয়মকে ভেঙ্গে ফেলতে যে নিয়মে দোকানে ঢোকার সে অযোগ্য, যে নিয়মে The Circle  মহিলারা ধূমপান করতে পারেনা প্রকাশ্যে, পুরুষের সঙ্গ ছাড়া অধিকার পায়না বাসে ট্রেনে ভ্রমনের, যে নিয়মে কন্যা সন্তান তাকে জন্ম দেওয়ার কারনে তার মাতা হয়অপয়া ... তাকে এসে আশ্রয় নিতে হয়, অবশেষে, জেলের কুঠুরীতে ...

  সমস্ত নিয়মের প্রতীক হয়ে হুসেনের সামনে মূর্ত্তি নেয় জুয়েলারী-শপ্এর ম্যানেজারটি। দোকানেরমিলিয়ন ডলারদামেরজুয়েলারীহয়ে ওঠে হুসেনের মুক্তি পরোয়ানার প্রতীক। ফলতঃ সে সকাল সকাল হানা দেয় জুয়েলারী-শপ্এ। হেলমেটে আজ তার মুখ ঢাকা অথচ সে কখনো হেলমেট, পরেনা বলে তার অফিস কর্তৃপক্ষ তাকে শাসিয়েছে বহুবার ... আজ সে হেল্মেটে মুখ ঢাকে কেননা আজ সে অন্য দিনেরহুসেননয়। এক অন্য হুসেন। সে ছিনিয়ে আনতে যাচ্ছে তারঅধিকার, তার অস্তিতের বৈধতা ... হবু শ্যালককে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে সে ঢুকেযায় জুয়েলারী-শপ্ ... পাঠক, তারপর ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলির বৃত্তান্ত আপনাদের জানা ... যাঁদের জানা নয় অনুরোধ করবো ছবিটি দেখে জেনে নিতে ... পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে, পাঠক, আপনি প্রকৃতই অনুভব করবেন যেন একটি যুগের অবসান ...

   ম্যানেজারটিএলার্মবেল্টিপে দিলে লোক জড়ো হয়। হুসেনের পালানোর পথ যায় বন্ধ হয়ে। এবার? এবার সে জেলে যাবে। সে জেলে যাবে? আবার ফিরে যাবে বৃত্তে? না। তা হয়না। সে বৃত্ত ভাংবে। মুহুর্ত্তে তার কাছে বৃত্তের প্রতীক একটিই মানুষ, সে জুয়েলারী-শপ্এর ম্যানেজার। ফলতঃ হুসেনের গুলি স্বাভাবিক ভাবেই তার খুলি দেয় উড়িয়ে।

     মুহুর্তের মধ্যে বদলে যায় বাস্তবতা। এবার? এবার কি ভাঙ্গলো বৃত্ত? দোকান ঘিরে ফেলছে লোকজন। আসছে পুলিশ। এবার? এবার তাকে ধরা দিতে হবে। যেতে হবে জেলে বৃত্তীয় নিয়মেই। না। হয়না। অতএব এইবার বৃত্তের প্রতীক সে নিজে। তার অস্তিত্ত্ব। সে গুলি চালায় নিজের কপালে ...

      অর্থাৎ, কামুআউটসাইডারযে খুনটি করেছিল এবং নিজেকে দিয়েছিল ধরিয়ে তার মূল্যে সেই চরত্রটি কিনে নিয়েছিল নিজেরআউটসাইডারপদবী। জানিয়েছিল তার অস্তিত্ত্বের মর্মে রয়েছে কেবলি শূন্যতা জানিয়েছিল শূন্যতার কাছে অন্যকে বধ করা বা নিজে বধ হওয়ার কোনো তফাৎ নেই। গোদারের মিচেলও চায়নি বৃত্ত ভাঙ্গতে। সে খুঁজছিল লে যাওয়ার মতন একটি ফাটল। এক সময় তার ক্লান্তি তাকে নিরস্ত করলো সন্ধান থেকে। সে আথঘাতী হলো পুলিশের গুলিতে। কিন্তু এই হুসেন, এই হত্যা আর আত্মহত্যার মূল্যে যাকে প্রতিষ্ঠা করলো তার নাম জীবন। The Circle’, ২০০০ সালে যে বৃত্ত নির্মাণ করেছিলেন পানাহি, ২০০৩ সালে তা ভাঙ্গতে তিনি হলেন প্রস্তুত ...

   কিন্তু ভাঙ্গলো কি বৃত্ত? হুসেনের আত্মহত্যা প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে উঠলেও হলোনা সঠিক প্রতিবাদ যে প্রতিবাদ ফলপ্রসূ। তার জন্য আমাদের প্রতীক্ষা করতে হলো আরো আট বছর। ২০১০ সাল পর্যন্ত। ২০১০ সালে পানাহি নির্মাণ করলেন The Accordion  যা ব্যাকরনগত ভাবে একটি শর্টফিল্ম এবং আমার অতি প্রিয় ছবি The Accordion 

     The Accordion  এর কাহিনীধারা সরল ( তবে সহজ নয় কদাপি), The Accordion  এর কাহিনী তার প্রায় অনুপস্থিত অবয়বে যে -নে- কথা বলে তার একটি কথা এই, যে, বৃত্তের শরীরের ফাটল ধরে লিয়ে আনা যায়না অস্তিত্বকে, নিজের কিংবা অন্যের খুলিতে গুলি চালিয়ে বা পাথর ছুঁড়ে মেরে ভেঙ্গে ফেলা যায়না বৃত্ত The Accordion   বলে, যে, স্বর্গ হয়তো নেই তথাপি মানুষ তার সরলতম আবেগে, সহজতম ইচ্ছায় গড়ে নিতে পারে স্বর্গের সিঁড়ি ... আর সিঁড়ি বেয়েই সে পার হতে পারে এই বৃত্ত, ভেঙ্গে ফেলতে পারে এই বৃত্ত । ঠিক যেমন নিজের ধ্বজা টিকে ভেঙ্গে ফেলে অন্যকে শুধু নয়, নিজেকেও মুক্ত করতে নেমেছিলেনরক্তকরবীর রাজা, শেষ দৃশ্যে

এই তিনটি ছবি, পানাহি, আমার মর্মে তাই নির্মাণ করে এক নির্বিকল্প ট্রিলজির।

৪।

অন্তিমে আমার মনে পড়ছে আরো দুইটি সিনেমার কথা। ১৯৩৯ রেনোয়াররুল্স্অফ্দ্য গেইম  আর ১৯৪৮ দেসিকাবাইসাইকেল থীফ্স্ প্রথমটি ফরাসী নিউ ওয়েভ্এর জন্মদাতা বা ঘরানার একটি মুখ্য ছবি। দ্বিতীয়টি দ্বারা ইটালীয়ান নিও রিয়েলিস্ট ধারার সূত্রপাত। কিন্তু ইরানী ছবিতে আমি যেন ছায়া দেখতে পাই দেসিকার যেন টের পাই ইরানী পরিচালকেরা এই সত্য টিকে মর্মে জেনেই আসেন সিনেমা করতে, যে, অভিজাত সম্প্রদায়, সব দেশের, সব জাতির, সব সময়েরমৃত। ফলে তাদের জীবনের অন্তঃশ্বাসশূন্যতাকে খুঁড়ে আজ আর অন্ধকারকেও সঠিক ভাবে আবিষ্কার করা সম্ভব নয়। তাই রেনোয়ার মতো তাঁরা অভিজাত সমাজের কেচ্ছাকে সচরাচর করেন না উপজীব্য। ফলে তাঁদের সিনেমা ভাষাও বদলে যায়। তথাপি উপস্থাপনার প্রশ্নে পানাহি, অন্ততঃ এখানে আলোচিত তিনটি ছবির দুটিতেই একটু -ইরানী। অন্যেরা যখন ধীরে ধীরে, দর্শককে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় ঢুকিয়ে দেন কাহিনীর কেন্দ্রে সেখানেসার্কলআরক্রিম্সন্গোল্ডএর পানাহি প্রথমেই দর্শকের সামনে এনে হাজির করেন এমন এক খন্ড ঘটনা যা দর্শককে এক টানে উপড়ে নিয়ে আসে তার নিজস্ব বাস্তবতা থেকে। তারপর আর ছবিটি আগাগোড়া না দেখে উপায় থাকেনা দর্শকের

  সপ্তর্ষি বিশ্বাস, এপ্রিল -১০, ২০১২