আমার পছন্দ

শনিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০

সাগর সঙ্গমেঃবিষয় কুরোসাওয়া

 সাগর সঙ্গমেঃবিষয় কুরোসাওয়া

                         সপ্তর্ষি বিশ্বাস

 [ প্রথম প্রকাশঃ মাসিক যুগশঙ্খ, পূজা সংখ্যা, ২০১০]


 


প্রাক্কথন

 কুরোসাওয়াএকটি সমুদ্রের নাম। অথবা মহাসমুদ্রের। কেবল উপমার্থেই নয় তাঁর ছবিগুলিও বলে সেই সমুদ্র কাহনই ।যেমন বলে রামায়ন,মহাভারত কিংবা ইলিয়াদ ।মহাকাব্যের মতনই তাঁর ছবির সমুদ্র অবয়বে মিশেযায় নানা কাহিনীর নদীগুলি, ঝর্ণাগুলি



                         পাঠক, মনেপড়ে কি The Hidden Fortress (১৯৫৮) এর আরম্ভ? সেই দুই ভবঘুরে ভাগ্যান্বেষীর কথোপকথন?  যে কথোপকথন, মূলতঃ, এপিকের ভাষ্যকারেরি নামান্তর মাত্র কেননা ক্রমে ছবির কাহিনী মূলতঃ উন্মোচিত হবে তাদেরি চোখ দিয়ে এপিকের অন্তর্গত ভাষ্যকারের উপস্থিতি, আরো ষ্পষ্ট ছিল নাকি Rashomon  (১৯৫০)?  পরবর্তীতে, Dersu Uzala  (১৯৭৫)তে ভাষ্যকারের ভূমিকাটিকে, যদিও আরেকটু অন্য ভাবে, তথাপিও,আরেকবার রচনা করেন কুরোসাওয়া অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি, যে, কেবল কাহিনী নির্মাণে নয়, কাহিনীর উপস্থাপনার ক্ষেত্রেও কুরোসাওয়াএপিক্যাল  এপিক্যালক্যামেরা চালনের রীতিতেও

                 তাঁর ক্যামেরার শ্লথ গমন, এক বিশেষ উচ্চতায় ক্যামেরাকে দাঁড় করানোএসব বহু আলোচিত। সেইসব তথাকথিত গ্রামাটিক্যাল প্রসঙ্গে তাই যাবোনা। প্রসঙ্গে শুধু এটুকুই বলবো, যে, মহাকাব্যে যেমন প্রায় প্রতিটি চরিত্রই অন্তিমে হয়ে ওঠেলার্জার দ্যান লাইফ্ সহজ উদাহরনে যুধিষ্ঠিরের সেই অন্তিম গমনের দৃশ্যে যুধিষ্ঠির কি পেরিয়া যাননামানুষএর সীমা, পরিসীমা ( যদি ধরেও নি যে মহাভারতের অন্যত্র তিনি তা পারেননি পার হতে ) অথবা মেধনাদের মৃত্যুর পরে শোকাহত, ক্রোধিত রাবণ? যুদ্ধশেষে, ইথাকায় প্রত্যাবর্তন পর্বে ইউলিসিস্‌? ঠিক তেমনি Throne of Blood  (১৯৫৭) , তীরবিদ্ধ ম্যাকবেথের ক্লোজআপ্টি যখন ভেসেওঠে পর্দ্দা জুড়ে তখন কি মনে হয়না কুরোসাওয়া আর মানতে চাইছেন না সিনেমার শুধু নয়, জীবনেরি সেই সাধারন সীমারেখা যাকে ঋত্বিক কখনো বলেছিলেনফেসিজম্অফ রেক্টেন্গ্বলে অথবা Red Beard  (১৯৬৫), সেই শিক্ষানবীশনবোরোযে দৃশ্যে স্ব ইচ্ছায় ফিরে আসে সেই রাগী ডাক্তাররেড্বীয়ার্ডএর কাছে, তখনকার সেই ক্লোজ আপ্ কিনবোরোএবংরেড্বীয়ার্ডউভয়কেই দেয় না এক অন্য মাত্রা যে মাত্রামেঘে ঢাকা তারা সেইদাদা আমি বাঁচতে চাই।দৃশ্যে কথা অনস্বীকার্য, যে, ভারতীয় চলচ্চিত্রে এতাবৎ , ঋত্বিক কুরোসাওয়ার লার্জার দ্যান্লাইফকে ছুঁইয়ে গেছেন ক্যামেরায়, কাহিনীতে সমসাময়িকে ইরাকের ছবিতে লক্ষ্যিত হয় প্রয়াস ইউরোপ-আমেরিকা কদাপি পথে যায়নি ইউরোপ-আমেরিকারলার্জার দ্যান্লাইফ্বড়জোরগড্ফাদারকিংবাসিটিজেন কেইন্




         কুরোসাওয়াকে অনুধাবনের প্রশ্নে ইউরোপ-আমেরিকার চলচ্চিত্রের শুধু নয়, ইউরোপ-আমেরিকার দর্শনের ভিত্তির সঙ্গে কুরোসাওয়ার দর্শনের ভিত্তির বিভেদ রেখার সংজ্ঞাটিকেও বুঝে নেওয়া প্রয়োজন সে আলোচনা বিশদে অন্যত্র করবার আসা ব্যক্ত করে এখানে এটুকুই শুধু বলেরাখি, যে, কান্ট্‌-হেগেল-দেকার্তে থেকে হালের সার্ত্রে, ইউরোপের সমূহ চিন্তাবীদের গমনপথ মূলতঃ তর্কের সূক্ষতায় আর ভারতীয় বা এশিয় মানসের যাত্রা মূলতঃ বিশ্বাসে, আত্মনিবেদনে ।নিমাই, কবীর, বুদ্ধ, মোহম্মদ সেই অর্থে একই পথের যাত্রী ফলতঃ বাঙ্গালীর বা ভারতের শ্রেষ্ঠ কবি মূলতঃ একজন শ্রেষ্ঠ সাধকই। আর সেই সাধনা পশ্চিমের কাছে এমনি দুর্বোধ্য, যে, স্বয়ং ইয়েট্স্সাহেব, যিনি ভারতের এই সাধকের, এক অর্থে, ছিলেনএম্বেসেডার্ তিনিও পরবর্তীতে সেই রবীন্দ্রনাথকে ঘোষয়া করেন অপাংক্তেয় বলে।এখানে আরেকটি কথা বলে রাখাও বোধহয় অপ্রাসঙ্গিক হবেনা,যে, পারস্যেরো ছিল এমনি সাধক-কবি-চিন্তাবীদ সহজেই উল্লেখ করাযায় রুমীর কথা পাঠক, মধ্য প্রাচ্যেরসাইক্লিস্ট, ‘ফাদার, ‘চিল্ড্রেন অফ্হেভেন্এদের কোথাও কি আপনি কোনোভাবে খুঁজে পান না রূমীকে?

       আমি মূলতঃ বলতে চাইছি, যে, কুরোসাওয়া মূলতঃ প্রাচ্যেরি সন্ততি যেমন বহুদূর ঋত্বিক ( তাঁর প্রথম জীবনের কমিউনিষ্ট প্রীতিহেতু এইবহুদূরশব্দটি লিখতে হলো কেননা প্রীতি ছায়াপাত তাঁর চিন্তাকে, পরিণামে তাঁর ছবিকে নানা ভাবেই ক্ষতগ্রস্থ করেছে ) ফলতঃ কুরোসাওয়াকে প্রায় অবচেতনেই অনুসরন করতে হয় মহাকাব্যের চরিত্রকে তার গঠনকে নিজের অগোচরেই, মহাকাব্যে যেমন, তেমনি তাঁর মর্মেও জন্ম নিতেথাকে এক ধ্রুবপদ

 


                                ফলতঃ যেগুলি কোনোভাবেই হয়তো নয় তাঁর প্রতিভার তুলনায় তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজ তথাপি এগুলিতেও চিনে নেওয়া যায় তাঁর সৃষ্টির নিজস্ব ধ্রুবপদগুলি, তাঁদের নিজস্ব আলাপ, বিস্তার, অন্তরার রীতি রশোমন,‘রেড বীয়ার্ড, ‘ইকিরুইত্যাদি হেন বহু আলোচিত ছবির পাশাপাশি যদি দেখাযায় তাঁর তুলনামূলক ভাবে কমপপুলার্,কম আলোচিত বাফ্লপ্ছবিগুলি যেমন  স্ট্রে ডগ্, ‘ড্রাঙ্কেন এঞ্জেল্ইডিয়ট্বাওয়ান ওয়ান্ডারফুল্সান্ডেইত্যাদি ছবিগুলিতেও চিনে নেওয়া যায় কুরোসাওয়াকে। চিনে নেওয়া যায় তাঁর সৃষ্টির ধ্রুবপদটিকে

যে ধ্রুবপদটির পথরেখা সন্ধানই আমার এই রচনার প্রেরণা

ধ্রুবপদ অর্থাৎ যে পদটির কাছে ফিরে ফিরে আসেন হিন্দুস্থানী উচ্চাংগ সঙ্গীতের গায়কেরা তাঁদের আলাপ-বিস্তার-অন্তরার যাত্রাপথে ঠিক তেমনি প্রতিজন প্রকৃত শিল্পীকেই তেমনি ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেতেহয় এক বা একাধিক নির্দ্দিষ্টভাবএর কেন্দ্রকে চেতনায় অবচেতনায় যেমন রবীন্দ্রনাথের সমস্ত সৃষ্টিই মূলতঃ অন্তর্গত জীবনদেবতাকে অনুভবের দিকে যাত্রার সঙ্গীত যেমন ইডিয়ট্থেকে ব্রাদার্স কার্মাজভ অবধি দস্তয়েভস্কি প্রচেষ্টা এক যুগোপযোগী যীশু চরিত্র চিত্রণের উদাহরন হাজির করাযায় আরো অসংখ্য আপাততঃ পাঠকের উপর সেই দায়টুকু চাপিয়ে দিয়ে চেষ্টানিই কুরোসাওয়ার ছবির সেই ধ্রবপদটির সন্ধানের

 

১।

কুরোসাওয়ার প্রথম ছবি  Sanshiro Sugata (১৯৪৩)’ কাহিনী Sanshiro Sugata নামের এক যুবকের জুদো শিক্ষার গল্প। কাহিনীর বলার ভঙ্গিতে মিশে আছে রূপ কথিকার আঙ্গিক। আঙ্গিক, ক্রমে পরবর্তি কুরোসাওয়াতে আর পাওয়া না গেলেও ছবির যে টি মৌলিক উপাদান কুরোসাওয়াতে ক্রমে পাওয়া যেতে থাকে পরিণত থেকে পরিণিততর রূপে তার প্রথম এবং প্রধানটি হলো তাঁর ছবির মহাকাব্যিক চলন চলন ক্যামেরার, চলন কাহিনীর মহাকাব্যের মতোই ধীরে ধীরে কুরোসাওয়া প্রতিষ্ঠা করেন চরিত্রগুলিকে    মহাকাব্যের মতোই, কেননা, মহাকাব্যে, অন্তিম বিচারে কেউই নয়খলনায়কফলে যাকে আপাতঃ দৃষ্টিতে মনেহয় খল বা খলনায়ক তারও অবস্থান থেকে সমগ্র প্রেক্ষিতটিকে বিশ্লেষন করলে টের পাওয়া যায় সে যে মূলতঃ অসহায় তার অবস্থানেরি কাছে পাঠক, ভাবুন ধৃতরাষ্ট্রের কথা, ভাবুনপিতাএই শব্দটির পরিধিতে আপনাকে বিন্যস্ত করে পুত্রেরপ্রতিষ্ঠাকেনা কামনা করে? সেই ঈশ্বরী পাটনী থেকে ধৃতরাষ্ট্রে সকলেই অসহায় এর কাছে আর এই অসহায়তাই কি ডেকে আনেনা সেই মহা যুদ্ধ? অথবা ভাবুন সেই নব যুবক প্যারীসের কথা। তিন দেবীর মধ্য থেকে  সুন্দরীতমা নির্বাচনের গুরুভার প্রাপ্ত হওয়ার পরে দেবী হেরা প্যারীস্কে প্রতিশ্রুতি দিলেন যে তাঁকে সুন্দরীতমা নির্বাচন করলে তিনি প্যারীসকে ইউরোপ এশিয়ার সম্রাটের আসন দান করবেন, দেবী এথেনা প্রতিশ্রুত হলেন প্যারীসকে শ্রেষ্ঠ যোদ্ধারূপে প্রতিষ্ঠিত করতে। পক্ষান্তরে দেবী আফ্রোদিতি যুবক প্যারীসকে দিলেন পৃথিবীর সুন্দরীতমা মহিলার স্বামীত্বের আশ্বাস স্বাভাবিক ভাবেই আপন যৌবণ লিবিডোর কাছে পরাজিত হলেন প্যারীস ।আর সেই পরাজয়ে ভষ্মীভূত হলো ট্রয় যেনবা ইয়াগো ব্যর্থ প্রেমের প্রতিশোধ ওথেলোর পরিণামে দুঃখিত হলেও,পাঠক, আমি এতাবৎ ইয়াগোকে পারিনা ভিলেন ভাবতে পারিনা কেননা স্বয়ং সেক্সপীয়ার তা চাননা




        সেক্সপীয়ার চাননা, মহাভারতকার চাননি বা চাননি টলষ্টয় ফলতঃ ওথেলোর পাশাপাশি ইয়াগোর বিষাদগাথাও আমাদের কাছে বিশদ শোনাতে হয়  সেক্সপীয়ারকে, বেদব্যাস কেবলমাত্র পান্ডবের গুণ কীর্তনেই ইতি টানেননা, দুর্যোধনের, কৌরবের কথাগুলিও যুক্তিদিয়ে, সম পরিমান আবেগ দিয়ে তিনি পৌঁছেদেন আমাদের কাছে ।যে কথাগুলি আরেক মহাকাব্যিকের লেখনীতেও ষ্পষ্ট হয় এইভাবেঃ

 শুন নিবেদন

পিতৃদেবএতকাল তব সিংহাসন

আমার নিন্দুকদল নিত্য ছিল ঘিরে ,

কণ্টকতরুর মতো নিষ্ঠুর প্রাচীরে

তোমার আমার মধ্যে রচি ব্যবধান

শুনায়েছে পাণ্ডবের নিত্যগুণগান ,

আমাদের নিত্য নিন্দাএইমতে , পিতঃ ,

পিতৃস্নেহ হতে মোরা চিরনির্বাসিত

এইমতে , পিতঃ , মোরা শিশুকাল হতে

হীনবলউৎসমুখে পিতৃস্নেহস্রোতে

পাষাণের বাধা পড়ি মোরা পরিক্ষীণ

শীর্ণ নদ , নষ্টপ্রাণ , গতিশক্তিহীন ,

পদে পদে প্রতিহত ; পাণ্ডবেরা স্ফীত ,

অখণ্ড , অবাধগতি

পাঠক, দুর্যোধনের এই যুক্তি কি কেবলি কথার কথা?

পাঠক, এই যুক্তি মহাকাব্যের যুক্তি, এই যুক্তিতেই ভ্রন্শকি ভিলেন নয়, ভিলেন নয় আনা আমলা স্বামীটি কিংবা আনা কারেনিনা নিজেও

   মহাকাব্যের এই যুক্তিগুলি কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হয়, ক্রমে, ধীরলয়ে মহাকাব্যের কলেবরও তাই স্ফীততর, তার অন্তর্গত চরিত্রগুলির মতোই, আমাদেরআধুনিকদের থেকে

কুরোসাওয়াতেও কেউভিলেননয় Sanshiro Sugata তে যেমন, Higaki, সেই ঈর্ষাপরায়ণ জুজুৎসুবিদও নয়ভিলেন কেননা সে প্রেমে অন্ধ কেননা সে জানে Sanshiro Sugata  তুলনায় সে বৃদ্ধ সুতরাং প্রেমাষ্পদাকে লাভ করার স্বাভাবিক অভিপ্রায়ে সে হয়েওঠে অন্ধ, দুর্দমনীয় High and Low  (১৯৬৩)তে কে ভিলেন? – একটি যুবক, যে তার আর্থ-সামাজিক অবস্থানের বিশদ বিশ্লেষণ করে জেনেছে যে তার নিজের জীবন-স্বপ্নের পথে সে হেঁটে যেতে পারবেনা কোনোদিনই আর সেইজানা মূল্যে সে মূলতঃ গিয়েছে উন্মাদ হয়েই তাকে কি ভিলেন বলাচলে? চলেনা। পাঠক,  এই কেউভেলেননয় এর থীমটি কুরোসাওয়ার ধ্রুবপদের একটি মূলস্বর। মহাকাব্যের নিয়মেই একে প্রতিষ্ঠাও করেছেন কুরোসাওয়া ফলতঃ মহাকাব্যের মতোই স্ফীত হয়েছে তাঁ ছবির কলেবরও।

 কেউভেলেননয় এর  স্বরটি, মহাকাব্য এবং সেক্সপীয়ার পরে স্বাভাবিক ভাবেই তিনি পেয়েছিলেন দস্তয়েভিস্কিতে। ফলতঃইডিয়ট্নিয়ে ছবি করতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি এমনকি প্রযোজকের সঙ্গে মনোমালিন্যের মূল্যেও। পরে আরেক রাশিয়ান মহারথী গোর্কী নাটক নিয়ে ছবি তোলার সময়েও মূল কাহিনীকে পরিবর্তিত করেছিলেন এমন ভাবে,যে, মূল নাটকে বা সেই কাহিনীর ভিত্তিতে তোলা রেঁনোয়ার ছবিতেভিলেনথাকলেও কুরোসাওয়ার ছবিতে সেই ভিলেনের অসহায়তা বা তাকে যে আসলেই কেই ভালবাসেনা সেই ব্যর্থতা আমাদের কাছে ধরাদেয় আর মনেপড়ে  Sanshiro Sugata সেই ঈর্ষাপরায়ণ জুজুৎসুবিদ Higaki কে

       ফরাসী ঔপন্যাসিক জর্জ সিমোনোকে কুরোসাওয়ার এতোদূর শ্রদ্ধা করার মর্মেও আমি দেখি কুরোসাওয়ার কেউভিলেননয়বিশ্বাসকেই। কেননা জর্জ সিমোনোর উপন্যাসে আমাদের সাক্ষাৎ ঘটে সেইসব তথাকথিত অপরাধীদের সঙ্গেই যাদের কথা, আগে, আমরা শুনেছিলাম দস্ত্যভস্কির সাইবেরিয়ার কাহনে সিমোনোতে আমাদের সাক্ষাৎ মেলে সেই বৃদ্ধ প্রেমিকের সঙ্গে যে প্রেমাস্পদার সঙ্গে জড়িত নয় কোনো দৈহিক সম্পর্কে, যে দিনের একটি বিশেষ সময়ে এসে প্রেমিকার দোকানে বসে থাকে শুধু সেই মানুষ সহ্য করতে পারেনা, একদিন, ঘটনাক্রমে যখন সে হাজির হয় নিজ স্বামীর দ্বারা প্রেমিকাটির দুর্বিষহ নিপীড়নের মুহুর্ত্তে অথচ তথ্যও তার অজানা ছিলোনা ।কিন্তু চোখের সামনে দৃশ্য দেখে সে আর নিজেকে পারেনা সামলাতে পরিণতি হয় খুনে, পরিণিতি গিলোটিনে সিমোনো ম্যান্স্হেড্ ( যা ব্যাটেল্অফ্নার্ভস্‌’ নামেও অনুদিত) সাক্ষাৎ মেলে কুরোসাওয়ারহাই এন্ড লোএর সেই ভাগ্য বিপর্যয়েসেডিস্টহয়ে যাওয়া যুবকের




        নানান সাক্ষাৎকারে, বিশেষতঃষ্ট্রে ডগ্ছবিটি বিষয়ে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে সিমোনো কথা বারবারই বলেছেন কুরোসাওয়া। বলেছেন তাঁর নিজের সিমোনো প্রীতির কথা। কারন হিসাবে বলেছেন একটিপেটি ক্রাইমএর জট খুলতে গিয়ে সিমোনো যে উপায়ে খুলেদেন আমাদের সমাজের আর তার অন্তর্গত সমাজবাসীর মনস্তত্ত্বের জট সেই উপায়টি তাঁর প্রিয়

           সময়ের ব্যবধানে দাঁড়িয়ে আমাকে অনুভব করতে হয়,যে, সিমোনোতেও মিশে আছেন দস্তয়ভস্কি আর মিশে থাকার মূল সূত্রটিও কেউভিলেননয়ধারনার উপর অনেক দূর প্রতিষ্ঠিত। দস্তয়েভস্কি ইডিয়ট্নিয়ে ছবি (১৯৫১)করতে গিয়েও সত্যটিকেই তিনি প্রমাণ করেন পুনরায় ইতোমধ্যে ১৯৪৯ সালে তিনি নির্মাণ করেছেনষ্ট্রে ডগ্যা মূলতঃ সমোনো আদলে লিখা তাঁর নিজেরি একটি কাহিনী

                   ষ্ট্রে ডগ্ সিমোনো আদলে তিনি একটিপেটি ক্রাইমএর অনুসন্ধানের পথে এগিয়ে গিয়ে একদিকে যেমন বলে ওঠেন, সিমোনোর মতোই, যে কেউই নয় মূলতঃভিলেনতেমনি আরেক মাত্রায় তিনি শোনান দস্তয়ভস্কি আরেকটিথীমে কথাও জানান দেন, ইডিয়টের মতোই, যে, যে মিশকিন্সে রোগোজিন যে ডঃ জ্যাকেল সে মিঃহাইড যে পুলিশ কর্মী   Murakami  আর তারই পিস্তল চুরি করে পালিয়ে যাওয়া চোর Yusa একই মুদ্রার দুইপিঠ, প্রকৃত প্রস্তাবে   একই দিনে, বাধ্যতামূলকঃ সৈন্য জীবনশেষে তারা ফিরছিল ট্রেইনে চেপে সেই ট্রেইনেই Yusa’ যথা সর্বস্ব গেলো চুরি হয়ে আর এতেই তার পথ রচিত হলো Murakami’ পথের বিপরীতে আর এই বৈপরীত্য এমনি মারাত্মক, যে, ইডিয়টের মিশকিন যদিও রক্ষা পেয়েছিল রোগোজিনের ছুরির আঘাত থেকে কিন্তু Yusa কে মরেযেতে হলো Murakami’ গুলিতে .. যে Murakami’ মূলতঃ Yusa’রই alter ego এখানে এসে সিমোনো পাঠকের ‘A man’s head ( বা A Game of nerves)  মনে পড়তে বাধ্য

Stray dog এর আরেক লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো সিমোনোর পুলিশ অফিসার ইন্সপেক্টার ম্যাগ্রের সঙ্গে কুরোসাওয়ার Sato San মিল অমিল গুলি মিলের ভাগই বেশী হলেও ম্যাগ্রে কিন্তু নিঃসন্তান আর Sato San এর সংসার ভরা কাচ্চাবাচ্চা নিঃসন্তান ম্যাগ্রে তাই মনে মনে সেই সমস্ত ছেলেমেয়েদেরি স্নেহ করতে থাকে সন্তানবৎ যাদেরি বয়স তার অজাত সন্তানের মতও বলে অনুভব হয় তার পক্ষান্তরে সাতো সান্নিজের সন্ততির প্রতি স্নেহের দায়েই স্নেহ করতে বাধ্যহয় বহির্জীবনের ভাগ্যহত ছেলেমেয়েদের ।প্রায় কাছাকাছি সময়ে তোলা ছবি Drunken Angel (১৯৪৮) লক্ষ্য করাযায় কেই ভিলেন নয় থীমের সাপেক্ষে দস্তয়েভস্কি সিমোনোর উপস্থিতি

২।




কুরোসাওয়ার ধ্রুবপদের আরেকটি মুখ্যস্বর অবশ্যই আত্ম আবিষ্কার অথবা আত্মা-আবিষ্কার একটি মানুষের গহনে লুকিয়ে থাকা বিপরীতমুখী মুখ গুলিও যেমন সত্য তেমনি সত্য তার গহনে ঘুমন্ত মহামানবটিও। বিশ্ব সাহিত্যে এই সত্যটির সপক্ষে শেষ লেখনী ধারন করেছিলেন সম্ভবতঃ ভিক্টর হুগো, দস্তয়ভস্কি আর টলষ্টয়। এর পরের সময়ে আমরা দেখবো আধুনিক লেখকেরা যা করে গিয়েছেন বা চেষ্টা নিয়েছেন করতে তা হলো সমস্ত দ্বিধা-বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও মানুষের গহনেই যে মহামানুষের বাস সেই কথাটিকে গৌণ করে তার খন্ডতাকেই যথাসম্ভবঃ বিস্তারিত করে দেখানোর স্বাভাবিক ভাবেই আধুনিক চলচ্চিত্রও নয় তার ব্যতিক্রম। সেই তথাকথিত আধুনিকেরা যখন সেই অন্তর্গত বিপরীত মুখগুলি দেখানোর কাজেই বিশেষ ব্যাপৃত ঠিক তেমন সময়েই কুরোসাওয়া নির্মাণ করছেন Kagemusha হেন ছবি যেখানে ‘shadow warrior’ ক্রমে আবিষ্কার করছে তার মর্মের প্রকৃত ‘warrior’টিকে   আর আবিষ্কারের প্রণালীটিও কিন্তু Meet John Doe (১৯৪১)হেন পাশ্চাত্য প্রণালী নয়। বরং সাবেক প্রাতিচ্যের সাধনালব্ধ আত্ম আবিষ্কারেরি নিকটবর্তী। সেই ‘shadow warrior’ এর একটি স্কেচ্যেন আমরা দেখেছিলাম Yojimbo  (১৯৬১)তে যেখানে নেহাৎই সহজে পয়সা বানানোর ধান্দায় এসে প্রোটাগোনিষ্ট্কে ক্রমে হয়ে উঠতে হয়েছিল মুক্তিদাতা গ্রামের প্রতিটি মানুষের ( কুরোসাওয়ার ছবি নিয়ে বলতে বসে তোসিরো মিফুনেকে নিয়ে কিছুই না বলা অন্যায় তাই এখানে উল্লেখ করে রাখলাম শুধু কেননা মহা-অভিনেতাকে নিয়ে পৃথক রচনা না লিখলে সে হবে গভীরতর পাপ কখনো তাঁকে নিয়েই লেখার ইচ্ছা এখানেই, পাঠক সমীপে,জ্ঞাপন করে রাখলাম)

      Kagemusha ছবিটি ১৯৮০ সালের। কিন্তু তাঁর সেই প্রথম ছবি Sanshiro Sugata (১৯৪৩)’তেও উপস্থিত সেই আত্ম আবিষ্কার আজো আনমনা হয়েযাই Sanshiro Sugata’ আত্ম আবিষ্কারের সেই প্রথন দৃশ্যে যেখানে মেঘ ভেঙ্গে সহসা জেগে উঠছে চাঁদ আর Sanshiro Sugata’ চোখের সামনে দল মেলে ফুটে উঠছে পদ্ম ।যেন মর্মে বেজেওঠে লালনের কোনো গান রুমীর কবিতা

  পাঠক এই বেজে ওঠা যে নেহাৎই কাকতালীয় নয় তাই ইঙ্গিত এই রচনার আরম্ভেই আমি দিয়েছি।

 

৩।

কুরোসাওয়ার আরেক স্বর সময়ের অন্তহীন প্রবাহের সত্যে নিহিত স্বরটিও মহাকাব্যিক সময়ের এই যাত্রার সত্যটিকে ক্যামেরায় বন্দী করার যে চেষ্টা তিনি নিয়েছিলেন Sanshiro Sugata তে তেমন অভিনব অথচ মর্মগ্রাহী চেষ্টা অন্যত্র কেন, স্বয়ং কুরোসাওয়াতেও আর দেখিছি কি? পাঠক, মনে করুন, Sanshiro Sugata’য় Sanshiro সেই ভেঙ্গে যাওয়া খড়ম ( জাপানী চপ্পলটির) কথা .. Sanshiro সেই ভাঙ্গা খড়ম ফেলে দিয়েগেলো রাতের রাস্তায়  .. তার পরে সেই খড়ম কে আমরা দেখলাম উদাসীন পরে থাকতে, পথে , দিবালোকে, দেখলাম তার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে সংখ্যাতীত পদাতিক দেখলাম সেই খড়ম নিয়ে খেলছে বাচ্চা কুকুর খড়ম ভিজছে বৃষ্টিতে তারপর খড়ম ভাসতে ভাসতে চলেছে নদীর জলের টানে যেন বলছে এখনো নয় এখনো নয় not yet not yet Madadayo… Madadayo..

   পাঠক এই সূত্রটি মনে রেখে যদি দেখাযায় কুরোসাওয়ার শেষ ছবি Madadayo (১৯৯৩) তাহলে তার ব্যঞ্জনা কি কিছুই যায়না বদলে? অথবা Dersu Uzala (১৯৭৫)’ একটি মাত্রাও কি নয় এই অপরাজয়, মৃত্যুর কাছে, পারপার্শ্বের প্রতিকূলতার কাছে?

এখানে এসে আবার চোখে ভেসে ওঠে সেই ছবি যেখানে, কেবল মাত্র সারমেয় কে সঙ্গীকরে হেঁটে চলেছেন যুধিষ্ঠির পেরিয়ে যাচ্ছেন সীমা, জীবনের। মরণের মরণ হেরেযাচ্ছে প্রতি পদে পদে ।পাঠক, ডেরসু মৃত্যু কি মৃত্যু? সেকি নয় মৃত্যুর প্রতি জীবনের করুণা? ‘মাদাদায়ো শেষ দৃশ্যে সেই বালতি আকৃতির বিশাল বীয়ার বোতল কি নয় জীবনের সেই বিশালতার প্রতিমা ( প্রতীক নয়, কেননা মহাকাব্যে প্রতীক থাকেনা, প্রতীক তথাকথিত আধুনিককের আমদানীকৃত একটি অবাস্তবতা) যা মহাকাব্যিক?

    মৃত্যুকে, তার নানানছদ্মবেশকে নানা স্থানেই উপেক্ষা করেছেন কুরোসাওয়া সেই Yojimbo তেই নায়ককে যেভাবে জীবনদান করেছিল কফিন ( যা পরে হলিউডি ওয়েস্টার্ণ বহু ব্যবহৃত) কিংবা একই ছবিতে সেই কফিন বিক্রেতা চরিত্রটি সেই সমস্তই প্রায় বৈদিক অর্থে মৃত্যুকে পার হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত যা ক্রমে পূর্ণতর রূপ পেয়েছে তাঁর পরের দিকের Dersu Uzala  বা Madadayo তে ।  

      পাঠক, এতোদূর এসে মনেহয় কুরোসাওয়া যে একটি ধ্রুপদী গমনের নাম তা হয়তো গিয়েছে প্রতিষ্ঠা করা। এইবার আসুন অনুসরনের চেষ্টা করি সেই মহাসমুদ্রের যাত্রাপথ যথাসম্ভব

৪।



পাঠক, আমরা আবার ফিরেযাই Sanshiro Sugata’ সেই দৃশ্যে যেখানে Sanshiro জুজুৎসু গুরু তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন পাঁকে, তাঁর ছাত্রাবাসের পিছনের জলাভূমিতে ।তিনি চাইছেন Sanshiro অনুভব করুক তার ভ্রমকে .. তার দৈহিক শক্তির ভ্রম, তার অহমিকার ভ্রম।অথচ অহংকারী যুবক Sanshiro তা করছে না ।বরং অক্ষম ক্রোধে আরো তলিয়ে যাচ্ছে পাঁকে শোনা যাচ্ছে ব্যাঙ্গের ডাক, আকাশে মেঘ মেঘে ঢেকে যাচ্ছে আকাশ ।কর্দমে ডুবতে ডুবতে Sanshiro আঁকড়ে ধরে আছে কাদায় গেঁথে থাকা একটি খুঁটি তবুও সে তলিয়ে যাচ্ছে ।সেই তলিয়ে যাওয়ার কিনারেই আপনার দল মেলে তার দিকে আর আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে একটি পদ্ম।জানিনা সেই পদ্মের সঙ্গে বুদ্ধদেবের হাতের পদ্মের কোনো সংশ্রব ঘটাতে চেয়েছেন কিনা কুরোসাওয়া তবে আমার মর্মে দুই পদ্ম মিলেমিশে একাকার হয়েগেছে ।কিন্তু Sanshiro’ চোখ যাচ্ছেনা সেই পদ্মের দিকে আকাশে আসছে মেঘ, ঢেকে দিচ্ছে চাঁদকে, জ্যোৎস্নাকে হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে পরক্ষণে

অকস্মাৎ Sanshiro দেখতে পাচ্ছে সেই শুভ্রপদ্ম ।জ্যোৎস্নায় আর দেখা, যেননির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ মুহুর্ত্তে তাকে দেখিয়ে দিচ্ছে নিজের ভুল সে যেন জেনে যাচ্ছে, লহমায়, যে, তাকে ঘিরে আছে এক এমন সুন্দর এক এমন পূর্ণতা।আপন অহং নিয়ে, পাপ, গ্লানি নিয়ে যার অংশ হওয়া যায়না   পূর্ণের, সৌন্দর্যের অংশ হতে গেলে যেতেহয় যে পথে সেইপথ নির্বিকল্প ক্ষমা চাওয়ার, ক্ষমা করার এমনকি আপনার কাছেও তৎক্ষণাৎ সে চীৎকার করে ভুল স্বীকার করছে , ক্ষমা চাইছে গুরুর কাছে গুরুও হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন তাকে পাঁক থেকে তুলে আনতে ।এখানে এসে, প্রথমবার দেখতে দেখতেও যা মনে পড়েছিল, আজো তাই মনে পড়েঃ

    দয়া দিয়ে হবে গো মোর জীবন ধুতে।

           নইলে কি আর পারব তোমার চরণ ছুঁতে।।

       

           আকূতিতেই কুরোসাওয়া পার হয়েযান সিমোনোকে। হয়তোবা দস্তয়েভস্কিকেও কেননা সিমোনো আমাদের কে দেখিয়ে দেন শুধু যন্ত্রণা দগ্ধ মুখগুলি যাতে আমাদের মর্মে জাগে করুণা কিন্তু চরিত্রেরা, সিমোনোর, দগ্ধ হয়, মূলতঃ, আপনার মর্মে ক্ষমা আর দয়ার অভাব হেতুই .দস্তয়েভস্কির চরিত্রেরা আলোড়িত হতেচায় ক্ষমায়,দয়ায় কিন্তু অন্তিম বিচারে সে থেকেযায় একটি বাসনাই। ফলে মিশ্কিনকে শেষ দৃশ্যে উন্মাদ হয়ে যেতেহয় পুনরায় ।ডিমিট্রি কার্মাজভ্কে বরন করে নিতেহয় কারাবাস।পক্ষান্তরে টলষ্টয়ের নেক্লুদভ্কিন্তু সমর্থ হয় সমস্ত বন্ধন ছেড়ে পথে নেমেযেতে শেষ দৃশ্যে অথবা

টলষ্টয়ের ফাদার সিয়ের্গীও যদিও টলষ্টয়ের কাহিনী নিয়ে ছবি করেননি কুরোসাওয়া তথাপি তাঁর নানা ছবিতেই দেখামেলে

নিরলম্বত্বধারী চরিত্রের।রেড বীয়ার্ডরেড বীয়ার্ডনিজে কি নন তেমনি এক সন্ন্যাসী? ছবির অন্তিমেরেড বীয়ার্ডএর ছাত্র, সেই শিক্ষানবীশ ডাক্তারও অনুসরন করে তাঁরই পদাংক শহরে বড় চাকরীকে এড়িয়ে সে ফিরেযায়রেড বীয়ার্ডএর সেই আশ্রমেই কিংবাহাই এন্ড্লো প্রোটাগনিষ্টগোন্ডো অন্তিমে প্রত্যাখ্যান করে প্রত্যাবর্তন বাণিজ্য জগতে

         ঐখানেই গোর্কী ‘Lower Depths’ কে নিয়ে ছবি (The Lower Depths ১৯৫৭) করতে গিয়ে তাঁকে পালটে ফেলতে হয় মূল নাটকের অনেক কিছুই । মাতালকে আরোগ্যের স্বপ্ন দেখাতে গিয়ে গোর্কী চরিত্রটি বা রেঁনোয়ার  The Lower Depths (১৯৩৬) এর চরিত্রটি বলে দূর শহরের এক হাসপাতালের কথা  আর কুরোসাওয়ার ছবিতে একই চরিত্র বলে দূরের পাহাড়ের উপরের একটি মন্দিরের কথা । গোর্কীর নাটকে বা রেঁনোয়ার ছবিতে নাতাসা স্বামী প্রায় ভিলেন, কিন্তু কুরোসাওয়ার ছবিতে সে যে এক ট্র্যাজিক চরিত্রই সে কথা বলেছি আগেই।




এমনি আরো অসংখ্য বদল ঘটেযায়, কাহিনীর, কুরোসাওয়ার হাতে আর বদলাতে বদলাতে, অনুভব হয়, যেন মানুষগুলি নয়, আমরাই রয়েছি    The Lower Depths   অসংখ্য সফল সিনেমাটিক ট্রিট্মেন্ট সত্ত্বেও রেঁনোয়ার  The Lower Depths  কিন্তু মাত্রাটি পায়না কিছুতে। পায়না কেননা রেঁনোয়া কাহিনীটিকে ব্যবহার করেন অপর কিছু উদ্ঘাটনের প্রয়োজনে আর আজ দুইটি ছবি থেকেই এতো বছরের দূরত্বে দাঁড়িয়ে অনুভব হয়, গোর্কী নাটকটি বা রেঁনোয়ার ছবিটি তাদের বিশেষ বিশেষ সময় বা ভাবনার নিরিখে যদিবা ক্ল্যাসিক তথাপি কুরোসাওয়ার The Lower Depths   চিরদিনের

    প্রকৃত প্রস্তাবে গোর্কী নাটকটি বলে একটি বিশেষ শ্রেণীর মানুষের বিজয়ের কথা আর তাই কাহিনীর শেষে দেখাযায়ভাস্কা মূলতঃ হয়তো সক্ষম এই Lower Depths থেকে উদ্ধারের পথে অপরকে পথ দেখানোর। রেঁনোয়াকৃত ছবিটি

মূলতঃ প্রায় একই খাতে বয়েযায় তবে রেঁনোয়ার ইঙ্গিত তৎকালীন এরিস্ট্রক্রেসির অন্তঃশ্বাস শূন্যতার দিকেই।

    মার্কসবাদীরা যাকে বলেশ্রেণীচরিত্রতা কুরোসাওয়ার পক্ষে কখনোই মেনে নেওয়া যে সম্ভব নয় তা তাঁর সেই প্রথম ছবি Sanshiro Sugata তেই প্রমাণিত তাঁর দর্শন বিশ্বাসের দর্শন। তাঁর পথ আত্মার মুক্তির পথ। তথাপি সমাজের নানা স্তরের মানুষের ভাবনার ভিন্নতাকে অস্বীকার করার কোনো প্রশ্নই ওঠেনা। সেই ভিন্নতাকে স্থাপনের শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন বোধহয় Seven Samurai (১৯৫৪) সেই সাত সামুরাইএর আর্থ সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে তাদের চিন্তা তাদের কর্ম প্রণালী ভিন্নতাকে তুলনা করে দেখতে বলি পাঠককে তবে সেই ছয় সামুরাইকে মূলতঃ যিনি নেতৃত্ব দেন, সেই Kambei Shimada তিনি কিন্তু এদের মধ্যে বয়ষ্কতম

কুরোসাওয়ার এই বয়স্ক চরিত্রগুলি আমাকে সর্বদাই মনে করিয়ে দেয় মহাভারতের বয়োজ্যেষ্ঠদের কৃপ,দ্রোণ,ভীষ্ম কিংবা বেদব্যাস, বিদুর, সঞ্জয়

পাঠক, এই মনে পড়িয়ে দেওয়া কি শুধুও কাকতালীয়?

৫।

সেক্সপীয়ারের কাহিনী, চরিত্রও যে বদলে যায় কুরোসাওয়ার হাতে তা একই কারনে।

শেক্সপিয়ার প্রথমে নাট্যকার। তারপরে কবি।

সেক্সপীয়ারকে ছাড়া আমরা সম্পূর্ণ হইনা। তাঁর কাছে যেতেহয় বহুবার। বহু অনুষঙ্গে। যেতেহয়, কুড়িয়ে নিতে হয় মণিমুক্তা, কিন্তু সে কুড়িয়ে আনা হয় নিজ নিজ আধারে আর যেহেতু এশিয়ান তাই কুরোসাওয়ার কুড়িয়ে আনার আধারও হয়না পাশ্চাত্যের আধারের সমধর্মী। প্রসঙ্গতঃ মনে পড়ছে অর্সন্ওয়েল্সের সেক্সপীয়ার বা সেক্সপীয়ার ভিত্তিক ছবিগুলির কথা। একথা অনস্বীকার্য্য, যে,সেক্সপীয়ারের ট্র্যাজিডি গুলির অবয়বে রয়েছে এক ধরনের অন্ধকার আর সেই অন্ধকারকে পর্দায় প্রকৃতই এনে হাজির করতে সক্ষম হয়েছেন অর্সন্ওয়েল্স্ কিন্তু ( একমাত্রব্যাড্স্লীপ্স্ওয়েল্ছাড়া) কুরোসাওয়ার সেক্সপীয়ার কিন্তু ভিন্ন মাত্রার।

     Throne of Blood  (১৯৫৭) লেডি ম্যাকবেথ প্রসব করেন মৃত সন্তান। যুক্তি হিসাবে কুরোসাওয়া জানান যে অপুত্রক দম্পতীর সিংহাসন লোভ, সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায়, তেমন বিশ্বাসযোগ্য হয়না। এটি বহু আলোচিত। কিন্তু একই ছবিতে ডাইনী বোনেদের নিয়তিহেন বৃদ্ধাতে রূপান্তরের পেছনে তেমন কোনো সমাজতাত্ত্বিক বা সিনেমাটিক লজিক যায়না প্রয়োগ করা। আমি বরং পরিবর্তনের যুক্তি দেখি ছবিটির নামকরনে Throne of Blood  বা Spider Web Castle নামে কুরোসাওয়া হয়তো বলতে চাইলেন,যে, সিংহাসন, মূলতঃ এক রক্তাক্ত বাস্তবতা। যে সেখানে যাবে সে হবেম্যাকবেথকেননা সিংহাসনের নিয়তি ই।সমস্ত প্রাসাদই মূলতঃ Spider Web Castle তাই কুরোসাওয়ার ম্যাকবেথ নিয়তির কাছে সেক্সপীয়ারের ম্যাকবেথের থেকেও বেশী অসহায় আর তাই ডাইনী বোনের বিভৎসতার বদলে সেই Spider Web বুনেচলা বৃদ্ধাকে নিয়ে এলেন কুরোসাওয়া।আর ছবিটিও শেষ হলো ম্যাকবেথের ধ্বংসে আর এই গানেঃ

Look upon the ruins

Of the castle of delusion

Haunted only now

By the spirits of those who perished

A scene of carnage

Born of consuming desire

Never changing

Now and throughout eternity

HERE STOOD

SPIDER'S WEB CASTLE

এখানে নিয়তিরূপিনী সেই বৃদ্ধার গানের ইংরেজি অনুবাদটিও উদ্ধৃত করবার লোভ সামলাতে পারছিনাঃ

Strange is the world

Why should men

Receive life in this world?

Men's lives are as meaningless

As the lives of insects

The terrible folly

Of such suffering

A man lives but

As briefly as a flower

Destined all too soon

To decay into the stink of flesh

Humanity strives

All its days

To sear its own flesh

In the flames of base desire

Exposing itself

To Fate's Five Calamities

Heaping karma upon karma

All that awaits Man

At the end

Of his travails

Is the stench of rotting flesh

That will yet blossom into flower

Its foul odor rendered

Into sweet perfume

Oh, fascinating

The life of Man

Oh, fascinating

[ সূত্রঃ  Criterion ডিভিডি ইংরেজি সাব্টাইটেল্‌ ]

৬।

একই ভাবে আর্থ সামাজিক বাস্তবতার প্রয়োজনে কুরোসাওয়ার কিং লীয়ার তিন কন্যার পরিবর্তে হয়েযান তিনটি পুত্রের জনক কিন্তু পরবর্তন যদিবা হয় সামাজিক বাস্তবতার খাতিরে, তাহলে, কুরোসাওয়ার কীং লীয়ার কে নিয়ে করা ছবির নাম কেন হয় Ran (১৯৮৫)যার অর্থ "chaos" বা "revolt"? কেননা লীয়ার রাজা নয়, বনভূমিটিই তাঁর ছবির উপজীব্য যেখানে রাজ্যচ্যুত রাজা ঘরে বেড়াচ্ছেন একা একা রাজ্য হারিয়ে কি? নাকি রাজত্ব, রাজপ্রাসাদ, রাজকীয় অহমিকা এই সমস্তের চেয়ে মুক্তি পেয়ে? এই পরিত্যাগ বা বর্জন রাজকীয় মহিমার, সে কি "revolt"? নাকি এই পরিত্যাগ বা বর্জনের গহনেও মিশেথাকা রাজকীয় অহমিকা "chaos"? জানিনা। তবে আমার মর্মে বনভূমিটিই তাঁর ছবির উপজীব্য হয়ে ধরাদেয় অদ্যাপি

বনভূমিতেই বৃদ্ধ রাজা সাক্ষাৎ পান সেই মানুষের যে তাঁরি অসীর আঘাতে অন্ধ হয়েছিল কোনোদিন হায়, সে কী আজ তাঁর চেয়েও ভালো চক্ষুষ্মান নয়?   দুর্গ ছেড়ে, দালান ছেড়ে, ঐসব  রাজত্ব, রাজপ্রাসাদ, রাজকীয় অহমিকা ছেড়ে বনভূমিকে আবিষ্কারের মাধ্যমেই রাজারো ঘটে আত্ম আবিষ্কার সেই অন্ধ বালকের কাছে রাজা শোনেন প্রভু বুদ্ধের কথা ।পাঠক মনেপড়ে Tsurumaru ‘ সেই কথাগুলিঃ

I was only a boy,but could I forget the man who burned down our castle? Who in exchange for my life gouged out my eyes?I try to be like my sister,to pray to Buddha and rid myself of hatred.

But not one day do I forget!Not one night do I sleep in peace!

I regret I cannot welcome you as befits the Great Lord.

Luckily, my sister gave me a flute.

I will play for you.

আমার মনে আসেঃ

শূন্য করিয়া রাখ্তোর বাঁশি,   বাজাবার যিনি বাজাবেন আসি

        ভিক্ষা না নিবি, তখনি জানিবি   ভরা আছে তোর ধন।।

আপনারে দিয়ে রচিলি রে কি আপনারই আবরণ !

        খুলে দেখ্দ্বার, অন্তরে তার আনন্দনিকেতন।।

ছবিটির শেষে সেই অন্ধের হাত থেকেই নেমে আসে প্রভু বুদ্ধের ছবি, সমস্ত পর্দ্দা জুড়ে । হয়তো এখানেই বোধহয় কুরোসাওয়া ছাপিয়ে যান সেক্সপীয়ারকে।

৭।

            কাহিনীর বদল ঘটেছে শেক্সপীয়ারের হ্যামলেটের ক্ষেত্রেও। এখানেও ছবির নাম হ্যামলেট নয় ছবির নাম  The Bad Sleep Well  ( ১৯৬০) তথাপি এখানেও উচ্চারিত হয় সেই প্রশ্ন “To be or not to be ” “Ikiru or Ikinai” …. তবে এই ছবিতে এই প্রশ্ন সম্ভবতঃ জীবনের দিগন্তের বাইরে মহাজীবনের কিংবা ইন্ফার্নো অস্তিত্ব আছে কিনা সেদিকে ধাবিত না হয়ে বরং ধাবিত হয়, Chuck Stephens যেমন বলেছেনঃ  What Kurosawa means to ask us—even as he asks it of himself—is, how do you topple a sleeping giant when you’re shackled to the very shadow upon which it surely will land?           সেদিকেই ফলতঃ এই ছবিতে হ্যাম্লেটের মৃত্যুর পরে অপর কোনো সুচেতন যুবরাজের রাজ্যাভিষেকের পরিবর্তে আমরা হ্যাম্লেটের কন্ঠে শুনি হতাশ উচ্চারন, শুনি সে বলেঃ I guess I don’t hate them enough”—

যেন জীবনানন্দের সেইঅদ্ভুত আঁধার এক এসেছে পৃথিবীতে আজ    যেন সিমোনোরFirst case of Maigret’ যেখানে অপরাধীকে শনাক্ত করা সত্ত্বেও সে থেকে যায় ইন্স্পেক্টার ম্যাগ্রের ধরা ছোঁওয়ার বাইরেই আর ম্যাগ্রেকে মনে মনে বয়ে বেড়াতে হয় সেই গ্লানি

Bad Sleep Well  আমার দেখা কুরোসাওয়ার সবচেয়ে অন্ধকার ছবি   মানুষের তথাকথিত সভ্যতার শরীর জোড়া অন্ধকারের এমন সামগ্রিক রূপ ১৯৫০ পরবর্তি কুরোসাওয়াতে আর নেই এমন নগ্ন প্রখর ভাবে।

৮।

১৯৫০ পুর্ববর্তী কুরোসাওয়ার একটি ছবির কথা এখানে উল্লেখ না করে পারছিনা ছবিটির নাম  One Wonderful Sunday।১৯৪৭ সালে তোলা ছবি অর্থাৎ এই ছবিটির পরে পরেই কুরোসাওয়া করবেন তাঁর Drunken Angel ,The Quiet Duel ,Stray Dog Drunken Angel হেন ‘dark tragedy’ গুলি

বহু আলোচক সমালোচকই এটিকে কুরোসাওয়ার ‘light work’ লে এড়িয়ে গেছেন। অথচ কুরোসাওয়ার মর্মের যে জীবন তৃষ্ণার সন্ধান আমরা পরবর্তিতে পাই তাঁর Ikiru(১৯৫২),Yojimbo (১৯৬১),Red Beard (১৯৬৫),Madadayo (১৯৯৩) তে সেই জীবন তৃষ্ণার কথাই এখানেও বলেন কুরোসাওয়া তাঁর তৎকালীন রূপকথা বলার ভঙ্গীতে যে ভংগী, পাঠক, আমরা লক্ষ্য করেছিলাম তাঁর প্রথম ছবি, সেই Sanshiro Sugata’তেও পাঠক, যদি না দেখে থাকেন তাহলে আপনাকে ছবিটি দেখবার অনুরোধ করা ভিন্ন আর কিছুই আমি বলতে পারিনা এখানে ।আর যদি দেখে থাকেন, তাহলে আসুন নীরবে, মুখোমুখি বসে ভাবি  One Wonderful Sunday সেই শেষ দৃশ্যটির কথা যেখানে যুদ্ধ বিদ্ধস্ত জাপানের এক শূন্য প্রেক্ষাগৃহে আপনার মর্মের আনন্দকে, জীবন তৃষ্ণাকে অবয়ব দিতে হাত তালিতে ফেটে পড়ছে সামান্য টি টাকা নিয়ে শহরে এক দিনের জন্য আমোদ করতে আসা সদ্য কৈসোরোত্তীর্ণ প্রেমিক-প্রেমিকা যেখানে, অবশেষে, সেই শূন্য প্রেক্ষাগৃহময় প্রতিধ্বনিত হাততালিতে, নায়ক-নায়িকার সঙ্গে, আমরাও ফেটে পড়ছি মনে মনে

 উপসংহার

 কুরোসাওয়া নিয়ে যতোনা বলা হলো বলা হলোনা তার চেয়ে ঢের বেশী। বলা গেলোনা তার চেয়ে ঢের বেশী আর তা তো স্বাভাবিক কেননা আধুনিকতম দূরবীক্ষণ দিয়েও কি মাপা যায়, মাপাযাবে, কোনোদিনই, এই সীমাহীন মহাকাশের মহাব্যাপ্তি?

 

১৬/০৬/২০১১১৯/০৬/২০১১